জয় লাহা, দুর্গাপুর, ৩ নভেম্বর: যুগ যুগ ধরে ভক্তদের মনস্কামনা পুর্ণ করেন মানকরের কবিরাজ বাড়ির মা আনন্দময়ী। ১৭৩৭ শকাব্দে ১২২২ সালে দেবীর স্বপ্নাদেশ পেয়ে মানকর শশ্মানে আদ্যা মায়ের পুজো শুরু করেন তৎকালীন কবিরাজ রাজবল্লভ গুপ্ত। বর্তমানে প্রায় ১১বিঘা জমি ওপর আনন্দময়ীতলা।
মানকর স্টেশন থেকে গুসকরা রোডে ২ কিলেমিটার। রয়েছে বিশাল পুস্করিণী ও নাটমন্দির। আর এখানেই মা কালী আনন্দময়ী রূপে পুজিত হন। কষ্টিপাথরের মুর্তি। তৎকালীন বর্ধমানের রাজা উদয়চাঁদের একমাত্র কন্যাকে মুমূর্ষু অবস্থা থেকে সুস্থ করেছিলেন কবিরাজ রাজবল্লভ গুপ্ত। আর তার দরুন রাজা উদয়চাঁদ মানকরের কিছু জমির জমিদারিত্ব দিয়েছিলেন। পরে রাজবল্লভকে রাজবৈদ্য হিসাবে নিযুক্ত করেছিলেন।
জানা গেছে, মাআনন্দময়ীর স্বপ্নাদেশ পেয়ে সুদুর কাশী থেকে মায়ের কষ্টিপাথরের মুর্তি নিয়ে এসেছিলেন। প্রায় সাড়ে তিন ফুট উচ্চতার মুর্তিটিতে শিবের নাভি থেকে উঠেছে শ্বেতপাথরের পদ্ম। তার ওপর আদ্যামা পদ্মাসনে অধিষ্টিত। পরবর্তী কালে দুষ্কৃতীরা ওই মূর্তির ওপর আঘাত করায় নতুন করে তৈরী করেছিলেন দাঁইহাটের শিল্পী নবীন ভাস্কর। আনন্দময়ীর মূল মন্দিরের দু’পাশে শ্বেতপাথরের দুই মহাকাল শিবলিঙ্গ রয়েছে। মন্দিরের সামনে রয়েছে নাট মন্দির। মন্দিরের পাশে পুষ্করনী। ওই জলে আনন্দময়ী মায়ের নিত্যস্নান ও সমস্ত পূজার কাজ হয়। কথিত আছে ওই পুষ্করনীর জল কখনই শুকোয় না।
বর্তমানে পুজোর দেখাশোনার দায়িত্বে রয়েছেন গোপাল কবিরাজ। তিনি জানান, “জল কমে যাওয়ায় একবার আশপাশের পুকুর থেকে জল ভর্তির জন্য আটটি উচ্চক্ষমতা সম্পন্ন পাম্প চালানো হয়েছিল। কিন্তু দিনরাত পাম্প চালিয়েও পুষ্করিণী ভর্তি করা যায়নি। বর্ষার জলে ভর্তি হয়।” তিনি আরও জানান, “একবার স্থানীয় তিন দুষ্কৃতী মায়ের কষ্টিপাথরের মুর্তি চুরি করে নিয়ে গিয়েছিল। তবে বেশীদুর নিয়ে যেতে পারেনি। মায়ের পুকুরপাড় পর্যন্ত গিয়ে অজ্ঞান হয়ে পড়েছিল তিনজনেই। পরবর্তীকালে তাদের পাপ কর্মের ফল পেয়েছিল। মুর্তিটি যে তুলে ছিল পরদিনই সে ট্রেনে কাটা পড়ে মারা যায়। মায়ের মুর্তির চোখে যে আঘাত করেছিল তার দুটি চোখ অন্ধ হয়ে গিয়েছিল। হাতে যে আঘাত করেছিল তার একটি হাত বোমাতে উড়ে গিয়েছিল।”
কথিত আছে আনন্দময়ী মা ছলচাতুরী পছন্দ করে না। একবার উত্তর ২৪ পরগনার এক ডাকাত সর্দার রাতের অন্ধকারে মন্দিরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে মায়ের রূপোর গয়না, বাসনপত্র পুঁটুলিতে বেঁধেছিল। পরে বেরোনোর সময় দরজার খিল খুলতে পারেনি। শত চেষ্টার পর ক্লান্ত হয়ে মন্দিরেই অজ্ঞান হয়ে পড়ে। পরদিন পুরোহিত পুজো করতে গিয়ে দরজা খুলে দেখে ডাকাত সর্দার পড়ে রয়েছে। পরে নিজেদের দোষ স্বীকার করে নেয় এবং ডাকাতি ছেড়ে দিয়ে মায়ের চরণে নিজেকে সঁপে দেয়।
দেবীর মাহাত্ম্য প্রসঙ্গে জানা গেছে, পুর্বপুরুষ ঈশ্বর গুপ্ত মায়ের একনিষ্ঠ সাধক ছিলেন। মায়ের স্বপ্নাদেশ পেয়েছিলেন, গঙ্গার জলে দাঁড়িয়ে অজ্ঞান হলে এক মাসের মধ্যে মৃত্যু হবে। একদিন হঠাৎ কাটোয়ায় গঙ্গার জলে দাঁড়িয়ে গায়ত্রী জপ করার সময় অজ্ঞান হয়ে পড়েন। গুরুদর্শনের পরে তাঁর মৃত্যু হয়। মৃত্যর পর তাঁর অস্থি পোড়ানো যায়নি। তাই এখনও মায়ের মন্দিরের পাশে অস্থি পোঁতা আছে।
আনন্দময়ীর পুকুরে রাতে নামা নিষিদ্ধ। বছর ২৫ আগে মানকর ভট্টাচার্য্য পাড়ার, হিরু ভট্টাচার্য্য একবার রাতে মাছ ধরার জন্য জাল নিয়ে পুকুরের নেমে ছিল। জাল তুলতেই শুধু সাপ উঠেছিল। প্রতিবছর মায়ের পুজোর আগে অঙ্গরাগ হয়। অর্থাৎ আনন্দময়ী মায়ের রং হয়। ওই সময় কবিরাজ বাড়ির লোকেদের মন্দিরে ঢোকা নিষিদ্ধ। মায়ের পুজোর প্রাচীন রীতি অনুযায়ী ১৮ রকমের মিষ্টান্ন, লবনবিহীন তরিতরকারি প্রসাদে দেওয়া হয়। নিশিকালে মায়ের পূজা হয় না। সন্ধ্যার মধ্যেই পুজো সম্পন্ন করতে হয়। পুজোর সময় নিয়ম অনুযায়ী ছাগ বলি হয়। দ্বিতীয়বার ছাগ বলির জন্য পুজো হয় না।
এছাড়াও দূর্গাপুজোর নবমীর দিন, জগদ্ধাত্রী পুজোর দিন, মাঘ মাসে রটন্তী পুজোর দিন ও জৈষ্ঠ্য মাসে ফলহারিনী অমাবস্যায় মা’য়ের পুজোয় ছাগ বলি দিতে হয়। বর্তমান পুজোর তত্ত্বাবধায়ক গোপালবাবু বলেন, “মৃগশিরা অর্থাৎ লাল রঙের ওপর কালো দাগ থাকা ছাগ বলি দেওয়া হয় না।” স্থানীয় বাসিন্দারা জানান, “ভক্তদের মনস্কামনা মা আনন্দময়ী পুর্ণ করে। ১৮৮০ সালে ওই কবিরাজ বাড়িতে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর একবার এসে মুগ্ধ হয়েছিলেন। বিদ্যাসাগর আসার জন্য তাঁর নামে মানকর বিদ্যাসাগর উচ্চবিদ্যালয়।