অশোক সেনগুপ্ত
আমাদের ভারত, কলকাতা, ৮ মার্চ: আন্তর্জাতিক নারী দিবসে আমতা রামসদয় কলেজের সমাজতত্ত্ব বিভাগের ভারপ্রাপ্ত বিভাগীয় প্রধান, দৃষ্টিহীন মানুষের সেবায় যুক্ত ‘দৃষ্টিকোণ’ নামক সংস্থার অন্যতম কর্ণধার অস্মিতা ব্যানার্জি তিনটি প্রশ্নের উত্তরে জানালেন তাঁর ভাবনা।
১) বিশ্বের কিছু উন্নত দেশে বিয়ে-সন্তানের বৃত্ত থেকে বেড়িয়ে আসছেন নারীদের একটা বড় অংশ। মহিলাদের অনেকে মনে করেন, ক্যারিয়ার তৈরির প্রতিযোগিতায় একটা বড় অন্তরায় ঘর-সংসার। আপনার কি মত, কেন?
উঃ— এই যে অনেকে মনে করেন, এই অনেকের সংখ্যাটা কত? হিসেব করে দেখবেন খুবই কম। মুশকিলটা হলো এরকম সার্ভে কেবল মহিলাদের নিয়েই হয়। কে বলতে পারে অনেক পুরুষও তাই মনে করেন। আসলে ঘর সংসার এই শব্দগুলো মাথায় এলেই আমরা মহিলাদের কথাই মাথায় নিয়ে আসি। কিন্তু সত্য হল একটা সংসার টেনে নিয়ে যেতে পুরুষ আর মহিলা উভয়েরই সমান গুরুত্ব ও দায়িত্ব। আগে যখন মহিলারা তুলনায় কম self dependent ছিলেন তখন তারা হোমমেকার হয়ে ঘর সংসারের মেজর দায়িত্ব সামলে দিয়েছেন। আর আমাদের মা কাকিমাদের এই sacrifice টাকেই আমরা সত্য ধরে নিয়েছি। ক্যারিয়ার আর সংসার দুটোকেই একসাথে ম্যানেজ করে বহু মহিলা পুরুষ উভয়েই চলেছেন। একটা সংসারে sacrifice থাকবেই, যারা সেটা করতে প্রস্তুত পুরুষ মহিলা নির্বিশেষে তারা তাদের পথে চলছেন আর যারা নন তারা এড়িয়ে গিয়ে নিজের মত আছেন। এটা সম্পূর্ণ তাঁদের মানসিকতার বিষয়। কোনো কিছুর সাথে কিছু সম্পর্কিত নয়। তবে হ্যাঁ, ঘর সংসারের দায়িত্ব মহিলাদের এই মানসিকতা নিয়ে যারা চলছেন তাদের মানসিকতাতেই অন্তরায় আছে।
২) বিয়ে-সন্তানের বৃত্ত থেকে বেড়িয়ে আসায় সেই মহিলার এবং সামগ্রিকভাবে সমাজের কি কোনও সমস্যা হতে পারে?
উঃ— সমাজ– এই জুজুটা বেশ মজার। আচ্ছা সমাজ কারা তৈরি করে? সমাজ তৈরি করে মানুষ। একটা সমাজে যে মানুষেরা থাকবে তারাই ঠিক করবে সমাজ কি ভাবে চলবে। ভবিষ্যতে যদি সমাজের মানুষরা ঠিক করে যে বিয়ে সন্তানের বৃত্ত থেকে বেরিয়ে আসবে তবে সমাজ ও সেভাবে পাল্টে যাবে। কে বলতে পারে সে সমাজ আরও ভালো কিছু হল। আমার মনে হয় এখনই এই নিয়ে গেল গেল রব তোলার সময় আসেনি। আমাদের দেশের পরিস্থিতির দিক দিয়ে যদি ভাবি, সেক্ষেত্রে যদি আর্থিক ভাবে সক্ষম মানুষেরা নিজেদের বাচ্চা নিজেদের বাচ্চা এই ধারণা থেকে বেড়িয়ে অনাথ পিছিয়ে পড়াদের দায়িত্ব নিতে শুরু করে তাতে সমাজের মঙ্গলই হবে।
৩) “প্রভু, মিটিয়াছে সাধ? এই সুললিত
সুগঠিত নবনীকোমল সৌন্দর্যের
যত গন্ধ যত মধু ছিল সকলি কি
করিয়াছ পান! আর-কিছু বাকি আছে?”
নয় দশক আগে এটি লিখেছিলেন রবীন্দ্রনাথ। এখনও কি সমাজে নারী ‘নবনীকোমল সৌন্দর্যের’ প্রতীক? না, নারীর ভাবমূর্তি আমূল বদলে গিয়েছে? আপনি কী মনে করেন?
উঃ— সৌন্দর্য্য জিনিসটা খুব আপেক্ষিক। এটা যে দেখছে তার চোখে লুকিয়ে আছে। তাই আমার কাছে যা সৌন্দর্যের প্রতীক অন্যের কাছে তা চরম কুৎসিতও হতে পারে। নারী মানে দশভূজা সে সব সামলে দেবে। কেনো দেবে? মেয়ে লক্ষ্মীমন্ত হবে, অর্থাৎ সে শান্তশিষ্ট হবে (যদিও লক্ষ্মীর চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য মোটেই শান্ত নয়। লক্ষ্মী চঞ্চলা, কিন্তু যেহেতু সম্পদের সাথে যুক্ত তাই সেটাই কাঙ্ক্ষিত হয়ে যায়)।
আসলে এগুলো সবই একটা গণ্ডি অথবা প্যাটার্ন তৈরির চেষ্টা। আমাদের দরকার মাথা থেকে লিঙ্গ টাকে ঝেড়ে ফেলে মানুষকে মানুষ হিসাবে দেখা। তাহলেই এসব রূপ, বিরূপ কেটে যাবে। চাকরিজীবীদের বাদই দিলাম, যে সব মহিলা ঘর সংসারটাকেই যত্ন সহকারে সাজিয়ে রাখলেন, তাঁদের কেবল বাহ্যিক রূপে বাঁধা কি ঠিক হবে?
আগে মানুষের বহু সন্তান থাকত, কিন্তু এখন একজন অথবা দু’জনে এসে ঠেকেছে। আগে বাবা মা এর মেয়েদের শিক্ষার চেয়েও বিয়ে নিয়ে চিন্তা বেশি থাকত। এখনকার যুগে যার একটি মাত্র মেয়ে সে তাকে একটি ছেলের মতোই মানুষ করছে। ফলে তাদের এক্সপেক্টেশন ও সেরকমই থাকছে। এখানেই শুরু হচ্ছে সমস্যা। যে নারী ভাব মূর্তি বদলে যাচ্ছে। আদপে বদলাচ্ছে না কিছুই, দেখার ধরণ বদলাচ্ছে। কারণ যেটা দেখে অভ্যস্ত নয় সেটা দেখলেই মনে হচ্ছে গেল গেল সব পাল্টে গেল।