তারক ভট্টাচার্য
আমাদের ভারত, ৮ জানুয়ারি: সিএএ, এনপিআর এবং এনআরসির প্রতিবাদে রাজ্যজুড়ে ধর্মঘটের ডাক দিয়েছে সিপিএম-সহ বামপন্থী দলগুলো। বুধবার এই ধর্মঘটে রাজ্যের বিভিন্ন প্রান্তে হিংসার ছবি চোখে এসেছে। কোথাও ট্রেনের নীচে বোমা রাখা হয়েছে। কোথাও পোড়ানো হয়েছে গাড়ি, কোথাও ভাঙা হয়েছে দোকানপাট। এদিন দ্ব্যর্থহীন ভাষায় সিপিএমের এই ধর্মঘটের রাজনীতির সমালোচনা করলেন রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। এদিন গঙ্গাসাগর থেকে কলকাতায় ফেরার আগে হেলিপ্যাডে সাংবাদিকদের মুখোমুখি হন মুখ্যমন্ত্রী। সেখানে তিনি বলেন, ‘প্রতিবছর চারটে করে বনধ ডাকে ওরা। এতে সাধারণ মানুষের কোন লাভ হয় না। বরং এতে তাদের ক্ষতি হয়। আমি এই আন্দোলনকে ধিক্কার জানাই।’
এদিন যেভাবে বিভিন্ন জায়গায় হিংসার ছবি ধরা পড়েছে, তারও নিন্দা করেছেন তিনি। মুখ্যমন্ত্রীর ভাষায়, ’আমার খুব খারাপ লাগছে, সিপিএমের আদর্শ বলে কিছু নেই। ট্রেন লাইনের নীচে বোমা রাখা কোনও আন্দোলন নয়, এটা গুন্ডামি। এতে ক্ষতি হলে সাধারণ মানুষের ক্ষতি হত। প্রতিবছর চারটে করে বনধ ডাকতে হবে! এটা কোন আন্দোলন হতে পারে না!’ এদিন ধর্মঘট নিয়ে প্রতিক্রিয়া দিতে গিয়ে সিপিএমকে চাঁচাছোলা ভাষায় আক্রমণ করেন মমতা। তিনি বলেন, ‘ওরা বছরে চারটে করে বনধ ডাকে। ওরা ভাবে বনধ না-করলে হয়তো পাবলিসিটি পাওয়া যাবে না। এটা সস্তার পাবলিসিটি। একটি বাসে বোমা মেরে সস্তার পাবলিসিটি হয়। এই ধরনের সস্তার পাবলিসিটি থেকে রাজনৈতিক মৃত্যু হওয়াও ভালো। রাজনৈতিক দলের আদর্শই হল রাজনীতিকে বাঁচিয়ে রাখা। ওদের ক্ষমতা থাকলে দিল্লিতে গিয়ে বনধ করুক। দিল্লিতে তো ওদের পার্টি অফিস আছে। সেখানে কি কিছু করেছে এখনও পর্যন্ত? জেএনইউর ছাত্ররা লড়াই করছে, ওদের সঙ্গে আমরা আছি। ক’টা বনধ করা হয়েছে দিল্লিতে? বাংলায় মানুষ শান্তিতে আছেন। আর ওরা ঘোলা জলে মাছ ধরতে নেমেছে।’ তিনি আরও বলেন, ‘৩৪ বছরে ওরা কিছুই করেনি। তার উপর এখন যেটুকু হচ্ছে, তা-ও গুন্ডামি করে ভেঙে দেওয়া হচ্ছে। আসলে ওরা উন্নয়নকে সহ্য করতে পারছে না। পুলিশ এর বিরুদ্ধে কড়া ব্যবস্থা নেবে। আমি সিপিএমের মতো গুলিমারার পন্থায় বিশ্বাস করি না। মারপিটকে বিশ্বাস করি না। আইন আইনের পথে চলবে। যাঁরা সরকারি সম্পত্তি নষ্ট করছেন, আইন যথাযথ ব্যবস্থা নেবে।’
আন্দোলন কেমন হওয়া উচিত এদিন তা-ও ব্যাখ্যা করেন মমতা। তিনি বলেন, ‘আন্দোলন করা অনেক কঠিন। আন্দোলন করতে গেলে রাস্তায় পড়ে থাকতে হয়। জীবন দিয়ে আদর্শ দিয়ে আন্দোলন করতে হয়। আমরা প্রতিদিন পথে পথে মিছিল করছি, মিটিং করছি, এটাকেই বলে আন্দোলন। আমি সিঙ্গুরের সময় ২৬ দিন অনশন করেছিলাম। কোথাও একটা বাসে কেউ হাত দেয়নি। একেই বলে আন্দোলন। লকআপে মৃত্যুর প্রতিবাদে মানবিক অধিকার রক্ষায় আমি ধর্মতলায় ২১ দিন ধরনা দিয়েছিলাম। এগুলোই হল আন্দোলন।’
মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এদিন মনে করিয়ে দেন, তাঁর দল ক্ষমতায় থেকেও আন্দোলন করছে। যে ইস্যুতে মানুষকে নিয়ে প্রতিদিন তিনি এরাজ্যে আন্দোলন করছেন, সেখানে বনধের যৌক্তিকতা কোথায়? মমতার ভাষায়, ‘এনপিআর-এনআরসি-ক্যা নিয়ে আমাদের আন্দোলন চলছে। আমরা সরকারে থেকেও এর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করছি। এর জন্য বুকের জোর থাকা দরকার। দল যেমন করছে, সরকারও প্রতিবাদ করছে। জেএনইউ-র ছাত্র-ছাত্রীদের উপর অত্যাচার হয়েছে। আমরা তখনই এর প্রতিবাদ করেছি। আমরা সেখানে আমাদের প্রতিনিধি দল পাঠিয়েছি। আমাদের প্রতিনিধি দল লখনউয়ে গিয়েছে। আসামে গিয়েছে। শাহিনবাগেও গিয়েছে। আমি সিপিএমকে অনুরোধ করব, ঘোলাজলে মাছ ধরতে নামবেন না।’
ধর্মঘটীদের তাণ্ডবের উদাহরণ দিতে গিয়ে তিনি বলেন, ‘বনধ-অবরোধের নাম করে দুর্গাপুরে বাইক আরোহীকে মারধর করা হয়েছে। কোথাও বাসযাত্রীদের আটক করে তাদের মারা হয়েছে। কোথাও পাথর ছোড়া হয়েছে সরকারি বাসে। কোথাও ডান্ডা মারা হয়েছে। এটার নাম দাদাগিরি, আন্দোলন নয়। আমি একে ধিক্কার জানাচ্ছি। এমনিতেই ভারতবর্ষের অর্থনীতিতে ধ্বস নেমেছে। আজকে মানুষের রোজগার কমে গিয়েছে। সেখানে কোথায় সাধারণ মানুষকে সাহায্য করবে, তার বদলে তাদের অসুবিধার মধ্যে ফেলে দেওয়া হচ্ছে।’
ধর্মঘটীদের মুখ্যমন্ত্রী মনে করিয়ে দিয়েছেন, এই ইস্যুকে সমর্থন করে তার দলও। বনধের পথে তার সমর্থন নেই। তিনি বলেন, ‘আমরা ইস্যুটাকে সমর্থন করি। ইস্যুকে সমর্থনের জন্য অনেক পথ রয়েছে। কিন্তু, গায়ের জোরে বনধ করা যাবে না। প্রতিবাদ জানানোর জন্য বনধ কেন? শান্তিপূর্ণ পথেই আন্দোলন করতে হবে। গায়ের জোরে বাংলায় বনধ হবে না। অতীতে করতে দেওয়া হয়নি, হবেও না।’ এদিন বনধ সমর্থনকারীদের মুখ্যমন্ত্রী অনুরোধ করেছেন, ‘আমি এখনও তাদের অনুরোধ করব গণতান্ত্রিক উপায়ে আন্দোলন করুন। শান্তিপূর্ণভাবে আন্দোলন করুন। আন্দোলনের নামে গুন্ডামি বন্ধ করুন। এই করতে করতে সিপিএম পার্টিটা সাইনবোর্ড এসে ঠেকেছে। এদের থেকে কেরালা সিপিএম অনেক ভালো। তবুও তারা একটা আদর্শ মেনে চলে। এরা সর্বনাশ করা ছাড়া, বনধ করা ছাড়া আর কিছুই করে না।’
বাংলার সিপিএমকে বিঁধে মমতা বলেন, ‘ওরা সারা ভারতবর্ষে কিছু করতে পারে না? ওরা তো অনেকদিনের পার্টি! কটা ঘেরাও, কটা কর্মসূচি ওরা করেছে, আমি জানতে চাই। বাংলায় শাসক দল, সরকার আন্দোলনটাকে সমর্থন করছে, এখানে বনধ কেন? যেখানে দরকার নেই সেখানে কেন আগবাড়িয়ে তুমি আগুন লাগাচ্ছ?’