মালতীলতা দোলে

অশোক সেনগুপ্ত

আমাদের ভারত, ২৫ জুন: ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেসের প্রাক্তনী, অধুনা একটি দৈনিকের বরিষ্ঠ সাংবাদিক সব্যসাচীর সঙ্গে (বন্দ্যোপাধ্যায়) খবরের সুবাদে নিয়মিত যোগাযোগ হয়। ও হোয়াটসঅ্যাপে একটা রূপরেখা দিয়ে বলল, দেবাঞ্জনের (কসবা টিকাকরণখ্যাত) ওপর এটা লেখ। জবাবে লিখলাম, “এর জন্য অনেক বড় রিপোর্টার আছে। অন্য একটা লিখছি। তোমাকে পাঠাচ্ছি।“

বিছানায় শুয়ে বাঁ পাশের জানলা দিয়ে পাশের বাড়ির দেওয়াল-টবে দিকে তাকিয়ে ছিলাম। ছড়িয়ে যাওয়া মালতীলতার ঝাড়। ফুলের গায়ে প্রতিনিয়ত ঘুরে বেড়ায় মৌমাছি, প্রজাপতির মত প্রকৃতিবন্ধুরা। ছোট্ট ছোট্ট পাখি এসে লাফালাফি করে।

বর্ষা মানে অনেক কিছু। বর্ষা মানে বৃষ্টি, ঘন মেঘ, মেঘ রোদ্দুরের খেলা, কারও কারও মন খারাপ করা। বর্ষা মানে কিছুটা মালতীলতা– মাধবীলতাও নামেও পরিচিত। নাকি মাধুরীলতা? তিনটি ফুলই ছবিতে দেখতে প্রায় একই রকম।

বড় আকারের লতানো উদ্ভিদ মালতীলতা। অনেকের বাড়িতেই দেখা যায়। এরা যে কোনও গাছের উপর উঠে সেই গাছটি মোটামুটিভাবে দখল করে ফেলে। এর বৈজ্ঞানিক নামটি ভালো করে লক্ষ্য করলে দেখা যায়, একটি অংশে ‘Benghalensis’ শব্দটি আছে। এ নাম থেকেই বোঝা যায় এটি বাংলার ফুল। মালতীলতা বা মাধবীলতা বাংলার উদ্ভিদ। এটি চিরসবুজ বনের লতানো উদ্ভিদ। ভারত, চীন, ফিলিপাইন, মালয়েশিয়া প্রভৃতি দেশের উদ্ভিদ।

মালতী ফুল দেখতে অনেকটা জুঁই-শিউলির মতোই, তবে মালতীর পাপড়িগুলো মোড়ানো। পাঁচটি পাপড়িতে অপূর্ব এর গড়ন, আছে সুগন্ধি। মালতী বর্ষার অন্যতম ফুল; কিন্তু গাছটি চমৎকার ভেষজ গুণসম্পন্ন। নানা কারণে মালতী বিখ্যাত ফুল। বাংলাসাহিত্যে মালতী বিশেষ স্থান দখল করে আছে। কারণ, বর্ষায় মালতীর শুভ্র বসন আর মধুগন্ধ সবাইকে মুগ্ধ করে। তা ছাড়া বেগুনি শিরার পাতাগুলো বেশ সুদৃশ্য।

এ ফুলের পুংকেশর ১০টা। আকৃতিতে এর মাঝে দৈর্ঘ্যে ৯টা পুংদণ্ড ছোট এবং একটি পুংদণ্ড লম্বা। ফলে মাধবীর ফুলের আকৃতিটা আমাদের অন্য ফুলগুলো থেকে কিছুটা ভিন্ন। এই ফুলটিকে দেখে হঠাৎ করে বর্ণনা করা কঠিন। মানুষ ‘মাধুরীলতা’ ফুলের সঙ্গে ‘মাধবীলতা’র ফুলকে এক মনে করে ভুল করে থাকেন।

“ওই মালতীলতা দোলে পিয়ালতরুর কোলে।“ ১৯৩৬-এ লিখেছিলেন রবীন্দ্রনাথ। স্বরলিপিকার ছিলেন শান্তিদেব ঘোষ। আবার বাংলাদেশের শিল্পী গেয়েছেন— “মাধবী লতা তুমি, তুমি কানন বালা/আমার গানের সুর তুমি তুমি গলার মালা/ দীঘির জলের হ্রদ তুমি।“

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে প্রথম বাবা হওয়ার আনন্দে ভাসিয়েছিল যে শিশু মেয়েটি, তার নাম কবি রেখেছিলেন ‘মাধুরীলতা’, ডাক নাম ‘বেলা’। জন্ম: ২৫ অক্টোবর ১৮৮৬—মৃত্যু: ১৬ মে ১৯১৮ সাল। তার জন্মের সময় রবীন্দ্রনাথের বয়স ছিল ২৫ বছর। মৃণালিনীর ১৩ পূর্ণ হয়নি। ছোটবেলা থেকেই বাবা-মা সহ বাড়ির সবারই প্রিয় ছিলেন, সবার কাছ থেকেই প্রচুর আদর পেত মাধুরীলতা। রবীন্দ্রনাথ কাবুলিওয়ালা গল্পের ‘মিনি’ চরিত্রটি সম্পর্কে হেমন্ত বালা দেবীকে চিঠিতে লিখে জানিয়েছিলেন— “মিনি আমার বড় মেয়ের আদর্শে রচিত।“

১৯১৭ সালে মাধুরীলতার ক্ষয়রোগ ধরা পড়লে রবীন্দ্রনাথ নিয়মিত কন্যাকে দেখতে গিয়েছেন, চিকিৎসার ব্যয়ভার বহন করেছেন। মৃত্যুর পর মাধুরীলতার স্মরণে রবীন্দ্রনাথ শান্তিনিকেতনে মাধুরীলতা বৃত্তি প্রবর্তন করেন। পলাতকা কাব্যগ্রন্থের শেষ প্রতিষ্ঠা কবিতাটি কন্যার মৃত্যুর অব্যবহিত পরেই লিখেছিলেন কবি—
এই কথা সদা শুনি ‘গেছে চলে-গেছে চলে’
তবু রাখি বলে
বলো না সে নাই
সে কথাটা মিথ্যা তাই
কিছুতেই সহেনা যে
মর্মে গিয়ে বাজে
……

মাধুরীলতার উইকিতে লেখা মধুমঞ্জরি/মধুমালতী (ইংরেজি: 
Chinese honeysuckle 
বা Rangoon creeper) লতানো গাছ। এর বৈজ্ঞানিক নাম 
Quisqualis indica, পরিবার Combretaceae। মাধুরীলতার হিন্দি নাম রঙ্গন-কা-বেল, বোম্বে অঞ্চলে বারমাসী, লাল চামেলী।

মালতীলতা, মাধবীলতা, মাধুরীলতা, মধুমঞ্জরি মধুমালতী— সব যেন মিলেমিশে একাকার। ফুল দেখার সঙ্গে মুঠোফোনের দৌলতে ঘুরে বেড়ালাম ভেষজবিজ্ঞান থেকে কবিতায়। এবং গানেও—
“মধুমালতী ডাকে আয়
ফুলফাগুনের এ খেলায়..(২)
যুঁথিকামিনী কতো কথা..(২)
গোপনে বলে মলোয়ায়
মধুমালতী ডাকে আয়।”

মনে আয় কথাটাকে মলোয়ায়— বুঝি রবীন্দ্রনাথ বলেই পেরেছিলেন।
এটা পাঠানোয় বিরক্তি উদ্রেক হলে আমি দায়ী এবং ক্ষমাপ্রার্থী। আর ভাল লাগলে দায়ী পাশের বাড়ির এই মালতীলতা।
লেখাটা শেষ করে প্রথম সব্যসাচীকেই পাঠালাম।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *