কুর্সি ছেড়ে ক্লাসকক্ষে, ‘আতঙ্কে কাঁটা’ কর্তা কর্ত্রীরা

ছবি ওপরে: ডঃ আশুতোষ ঘোষ
অশোক সেনগুপ্ত, আমাদের ভারত, ৮ ফেব্রুয়ারি: বিশ্ববিদ্যালয়ের শুরু থেকে দেখভাল করার দায়িত্বে ছিলেন উপাচার্য ডঃ আশুতোষ ঘোষ। ভারত বিখ্যাত এই বিজ্ঞানী ফের প্রস্তুতি শুরু করেছেন শিক্ষকতায় ফিরে আসার। চলতি সপ্তাহেই মেয়াদ শেষ হচ্ছে ঝাড়গ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি ডঃ অমিয় পন্ডার কার্যকালের মেয়াদ। কিছুকাল উপাচার্যের দায়িত্ব সামলে ফের শিক্ষকতায় ফিরে এসেছেন ডঃ ওমপ্রকাশ মিশ্র। সংখ্যাটা ক্রমেই বাড়ছে। ২৫ মাস দায়িত্ব পালন করে মহাত্মা গান্ধী বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি ডঃ সুব্রত দে’ও ফিরে এলেন শিক্ষকতায়। নয়া ভিসি নিয়োগ হচ্ছেন না। তাই অন্যত্র এঁদের প্রশাসনিক অভিজ্ঞতার সুফল নেওয়াও সম্ভব হচ্ছে না। পশ্চিমবঙ্গে ক্রমেই বাড়ছে কুর্সি থেকে ক্লাসকক্ষে ফেরার তালিকা।


ছবি: ডঃ অমিও পন্ডা

অনেকে মনে করেন বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যর দায়িত্ব চলে যাওয়া অনেকটা ‘পুনর্মূষিক ভব’-র সামিল। যে কারণে অধিকাংশ উপাচার্যই চেষ্টা করেন, এখন করছেনও ওই দায়িত্বে থেকে যাওয়ার। সেটা সফল না হলে রাগ, দুঃখ, ক্ষোভ, অভিমানের শিকার হন অনেকে। এ কারণে প্রাক্তন উপাচার্য শিক্ষকতায় যোগ না দিয়ে ছুটি নিয়ে বসে আছেন বা ছিলেন, এমন উদাহরণও আছে। এক প্রাক্তন উপাচার্য এই প্রতিবেদককে বলেন, “আসলে মশাই, একে বলে আত্মশ্লাঘা। টাকা গুনতে পারে না, পড়াতে পারে না, এমন সব লোকজনকে উদ্দেশ্যমূলকভাবে ভিসি করলে যা হয়, তাই হচ্ছে। সিস্টেমটা ভেঙে তছনছ করে দিল।”


ছবি: ডঃ ওমপ্রকাশ মিশ্র

উত্তরবঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের অস্থায়ী উপাচার্য হিসাবে ওমপ্রকাশবাবুর নাম ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গে প্রশ্ন ওঠে, রাজ্যের শাসক দলে নাম লেখানো এরকম ব্যক্তিত্বকে এই মর্যাদা দেওয়ার যুক্তি কোথায়? তিনি অবশ্য প্রকাশ্যে দাবি করেন, রাজনীতির সঙ্গে যোগাযোগ ছিন্ন করেই তিনি উপাচার্যর দায়িত্ব নিয়েছেন। মেয়াদ শেষ হওয়ার পর তাঁর পুনর্নিয়োগের সম্ভাবনা এবং আশা— দুইই ছিল। এ কারণে সম্ভাব্য আরও দুই অধ্যাপকের সঙ্গে রাজভবনে গিয়ে আচার্য-রাজ্যপালের কাছে সাক্ষাৎকার দিয়েও এসেছেন। কিন্তু ভাগ্যে শিকে ছেঁড়েনি। এই প্রতিবেদককে তিনি বলেন, “২৬ জানুয়ারি মেয়াদ অন্তে ফিরে এসেছি যাদবপুরে। আন্তর্জাতিক সম্পর্কের অধ্যাপনায়।”

মেয়াদ অন্তে সেভাবে শিক্ষকতায় ফিরতে হয়নি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের সদ্যপ্রাক্তন অস্থায়ী উপাচার্য ডঃ আশিস চ্যাটার্জিকে। কারণ, তিনি ওই প্রতিষ্ঠানেরই সহ উপাচার্য। প্রশাসনের গুরুদায়িত্ব এখনও তাঁর কাঁধে। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন উপাচার্য তথা বর্তমানে সিঙুর রানি রাসমণি গ্রিন ইউনিভার্সিটির উপাচার্য ডঃ আশুতোষ ঘোষ এখন দিন গুনছেন। ১৯ ফেব্রুয়ারি তাঁর ভিসি পদের মেয়াদ শেষ হবে। তিনি অবশ্য এই প্রতিবেদককে বলেন, “আমার আক্ষেপের কিছু নেই। উচ্চ শিক্ষা দফতরের নির্দেশক্রমে যখন যা করার করেছি। আবার রসায়নের অধ্যাপনা করব। রাজাবাজার বিজ্ঞান কলেজের ওই ঘরে ফিরে আসব। আপনি তো এসেছেন ওই ঘরে।”

কিন্তু নতুন প্রতিষ্ঠানকে তার আঁতুরঘর থেকে বার করে হামাগুড়ি দিতে শিখিয়েছেন। সেই সদ্যোজাতের বিকাশ হোঁচট খাবে না? আশুতোষবাবুর কথায়, “প্রতিষ্ঠান নিজের মত এগোবে। নতুন ভবন তৈরি হচ্ছে। মোট ১৯৪ কোটি টাকার প্রকল্প ছাড়পত্র পেয়েছে। আটতলা ভবন হবে। চলতি বছর প্রথম পর্যায়ের কাজ শেষ হওয়ার কথা। এই পর্যায়ে হবে ভবনটির তৃতীয় তল পর্যন্ত। এর জন্য ৪৫ কোটি টাকা খরচ হবে। আপাতত হুগলির দুটি কলেজে হচ্ছে ক্লাস। পড়ুয়ার সংখ্যা বাড়ছে। কী হবে, সরকার সিদ্ধান্ত নেবে।” আশুতোষবাবু জানান, হিন্দি বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি অধ্যাপক দামোদর মিশ্রকে ফিরে যেতে হয়েছে শিক্ষকতায়। ঝাড়গ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি অমিয় পন্ডা ফিরে যাবেন আগামী ১২ই।

সদ্যোজাত প্রতিষ্ঠানকে অপত্যস্নেহে বড় করার চেষ্টা করেও ‘আচমকা’ বিদায় নিতে হয়েছিল রায়গঞ্জ বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ডঃ অনিল ভুঁইমালিকে। আচমকা কেন? এই প্রতিবেদককে তিনি বলেন, “আমি উত্তরবঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াতাম। সাড়ে ছ’বছর ভিসি ছিলাম। ২০১৫ সালে নতুন প্রতিষ্ঠান তৈরির পর আমাকে দায়িত্ব দেওয়া হল। প্রথমে এক বছর, তার পর ৬ মাস করে। তার পর সার্চ কমিটি তৈরি করে চার বছরের জন্য দায়িত্ব দেওয়া হল। মেয়াদ যখন ফুরিয়ে আসছে আমি উচ্চশিক্ষা দফতরের সচিবকে লিখে জানালাম। কোনও উত্তর আসেনি। পুনর্নিয়োগের একটা আশ্বাস পেয়েছিলাম। তাই আশান্বিত ছিলাম। কিন্তু অনেকটা দুম করেই একদিন মেয়াদ শেষের নোটিশ পেলাম। ওই সময়েও বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় একটা ডামাডোল চলছিল। আরও খারাপ লাগল কিছু বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি পুনর্নিয়োগ পেয়ে গেলেন, আমি পেলাম না। একটা তো হতাশা আসবেই। সবাই সম্মানের সঙ্গে কাজ করতে চান। যাই হোক, আস্তে আস্তে মানিয়ে নিয়েছি। এখন উত্তরবঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয়ে অর্থনীতির পঠনপাঠন ও গবেষণার সঙ্গে যুক্ত।“


ছবি: ডঃ অনিল ভুঁইমালি

অনিলবাবু বলেন, আমি তবু ৬৫ বছর অবধি পড়ানোর সুযোগ পেয়েছি। কেউ কেউ ৬০-৬২-৬৫-র গেঁড়োয় আটকে গেছেন। যেমন যাদবপুরের রসায়নের অধ্যাপক সোমনাথ ঘোষ। উনি উত্তরবঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয়ে চার বছরের জন্য ভিসি হয়েছিলেন। পুনর্নিয়োগ হয়নি। অবসর নিতে হয়েছিল। ডিপিআই দীপক মণ্ডল পুরুলিয়ার সিধো কানহ বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য হয়েছিলেন। তাঁরও পুনর্নিয়োগ হয়নি। অবসর নিতে হয়েছিল। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের দর্শন বিভাগের এক অধ্যাপক কয়েক বছর আগে সংস্কৃত বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি হয়ে এসেছিলেন। তাঁরও পুনর্নিয়োগ হয়নি। শিক্ষকতায় ফিরতে হয়েছিল। অসম কেন্দ্রীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের এক শিক্ষক কল্যাণী বিশ্ববিদ্যালয়ে ভিসি হয়ে এসেছিলেন। মেয়াদশেষে তাঁকে ফের শিক্ষকতায় ফিরতে হয়।

মহাত্মা গান্ধী বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি সুব্রত দে-ও ক’দিন আগে মেয়াদ অন্তে শিক্ষকতায় ফিরে গেছেন। এই প্রতিবেদককে তিনি বলেন, “আমি বিদ্যাসাগর বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রাণীবিদ্যা পড়াতাম। উপাচার্যের দায়িত্ব পাই ২০২০-র ৩ নভেম্বর। মেয়াদ শেষে ৩ ফেব্রুয়ারি বিদ্যাসাগর বিশ্ববিদ্যালয়ে ফের যোগ দিয়েছি। খারাপ তো একটু লাগবেই। সবার যেমন মনোভাব হয়, তেমনই। স্নেহের পড়ুয়াদের মিস করি। তবে, অত ভাবার অবকাশ নেই। এখানে অনেক পিএইচডি বকেয়া আছে। বিদেশের চাহিদাও আছে। তাই ব্যস্ততা যথেষ্ঠ।”

দীর্ঘকাল একাধিক বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনের উচ্চপদে ছিলেন এমন এক প্রাক্তন উপাচার্য এই প্রতিবেদককে বলেন, “এখন উপাচার্যদের অধিকাংশই প্রতিষ্ঠানের ভবিষ্যতের চেয়ে নিজের ভবিষ্যতের কথা বেশি করে ভাবেন। প্রভাব খাটিয়ে, রাজনীতির শাসক-মাথাদের বুঝিয়ে উপাচার্যদের অবসরের বয়স ৭০ করে নেওয়া হয়েছে। কিন্তু ইউজিসি-র নির্দেশিকা যে লঙ্ঘন করা যায় না, সেটা বুঝতে চাননি। কেবল ক্ষমতার অলিন্দে থাকার বাসনায় এভাবে বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বোচ্চ কুর্সিতে টিকে থাকা যায় না। কুর্সি ছেড়ে ক্লাসকক্ষে আসার আতঙ্কে তাই কাঁটা কর্তা কর্ত্রীদের অনেকে। এই তো বিজ্ঞাপন দিয়ে বোম্বে, পুনে প্রভৃতি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য চাওয়া হয়েছে। ওয়েবসাইটে প্রার্থীদের পরিচয় সবাই জানতে পারবেন। এমন মানুষকে বেছে নেওয়ার কথা যিনি ‘এ ম্যান অফ হাইয়েস্ট ইনটিগ্রিটি অ্যান্ড মরাল’। কিন্তু যেভাবে এ রাজ্যে মেয়াদবৃদ্ধি হয়েছে, তা অন্যায়, অনৈতিক। উপাচার্যদের সবাইকেই সরতে হবে। কাউকে কাউকে তো যেতে হয়েছে কারার অন্তরালে। যেমন সুবীরেশ ভট্টাচার্য।”

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *