সৌভিক বন্দ্যোপাধ্যায়, কলকাতা, ১০ ফেব্রুয়ারি:
২০১৯ সালের ৮ অক্টোবর টালা থানায় একটি গুরুতর অভিযোগ জমা পড়ে। এক স্থানীয় মহিলা জানান, তাঁর ১৪ বছরের কিশোরী মেয়ে নিখোঁজ। ৭ অক্টোবর দুপুর ১টা থেকে ১.৩০-এর মধ্যে সে বাড়ি থেকে বেরিয়েছিল। আর ফেরেনি। মহিলার আশঙ্কা, তাঁর মেয়েকে হয়তো অপহরণ করেছে কেউ।
নিখোঁজ মেয়েটির মোবাইল নম্বর তদন্তকারী অফিসারদের দিয়েছিলেন সেই মহিলা। শুরু হয় প্রযুক্তি-প্রহরা। খবর দেওয়া হয় সোর্সদেরও। জানা যায়, গার্ডেনরিচের এক যুবকের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল সেই কিশোরী মেয়েটির। মেয়েটির পাশাপাশি সেই যুবকও কয়েক দিন ধরে নিরুদ্দেশ। তদন্তকারী অফিসারদের অঙ্ক মেলাতে আর অসুবিধে হয়নি।
নিখোঁজ কিশোরীর মোবাইলের টাওয়ার লোকেশন ট্র্যাক করে জানা যায়, তার অবস্থান তখন নিউ দিল্লিতে। এই কেসের তদন্তকারী অফিসার সাব ইনস্পেকটর মানসী মাইতি রায়ের নেতৃত্বে টালা থানার বিশেষ টিম দ্রুত রওনা দেয় নিউ দিল্লির উদ্দেশ্যে। ১৯ অক্টোবর, জামিয়া নগর থানার সাহায্য নিয়ে বাটলা হাউজ এলাকায় তল্লাশি চালানো হয়। কিন্তু মেয়েটির খোঁজ মেলেনি। খোঁজ মেলেনি সেই যুবকেরও।
প্রথম তল্লাশি ব্যর্থ হলেও মেয়েটির খোঁজ জারি থাকে। অবশেষে, ২ নভেম্বর, তদন্তকারী টিমের এক অফিসারের থেকে পাওয়া নিশ্চিত খবরের ভিত্তিতে টালা অঞ্চলের নিত্যগোপাল চ্যাটার্জি লেনের সামনে থেকে কিশোরী মেয়েটিকে উদ্ধার করে টালা থানার বিশেষ টিম।
মেয়েটি জানায়, কিছুদিন আগে আজম আলি ওরফে মহঃ শোয়েব নামের একটি যুবকের সঙ্গে তার পরিচয় হয়। আজম গার্ডেনরিচের বাসিন্দা, পেশায় শ্যামবাজার-মেটিয়াবুরুজ রুটের একটি প্রাইভেট মিনিবাসের খালাসি। পরিচিতি ঘনিষ্ঠতায় পরিণত হতে বিশেষ সময় লাগেনি। কিশোরী মেয়েটিকে বিয়ের প্রস্তাব দেয় আজম। প্রেমের দুর্নিবার আকর্ষণে সেই প্রস্তাব এড়াতে পারেনি সেই কিশোরী। বাড়িতে জানানো সম্ভব ছিল না। তাই আজমের পরামর্শমতো সে পালায় বাড়ি থেকে। তারপর আজম তাকে নিউ দিল্লিতে নিয়ে যায়। সেখানে বিয়েও হয় দু’জনের। আইনত কোনও নাবালিকা মেয়ের সঙ্গে বিবাহ দণ্ডনীয় অপরাধ। সেই কারণে, বিয়ে করার আগে মেয়েটির বয়স সংক্রান্ত কিছু জাল নথি তৈরি করিয়েছিল আজম। ঘর বাঁধার আশায় এইসবই মুখ বুজে মেনে নিয়েছিল নাবালিকা মেয়েটি।
এরপর একাধিকবার মেয়েটির সঙ্গে সহবাস করে আজম। দু’জনে কলকাতায় ফিরে আসে ১ নভেম্বর। কলকাতায় ফিরতেই আজমের হাবভাব বদলে যায়। মেয়েটির সঙ্গে সমস্ত সম্পর্ক ছিন্ন করে দেয় সে।
মেয়েটির মেডিকেল রিপোর্টেও সহবাসের প্রমাণ মেলে। আজমের খোঁজ শুরু হয়। বেগতিক বুঝে সে তখন গা ঢাকা দিয়েছে। সোর্সদের খবর দেওয়া হয়। ফের শুরু হয় প্রযুক্তি-প্রহরা। অবশেষে এই বছরের ২১ জানুয়ারি সন্ধে ৭.৪০ নাগাদ আজমকে তার বাড়ির সামনে থেকেই গ্রেপ্তার করে টালা থানার বিশেষ টিম। তল্লাশিতে আজমের জিম্মা থেকেই উদ্ধার হয় তার ও সেই কিশোরীর বিয়ে সংক্রান্ত সমস্ত জাল নথি।
আজমের বিরুদ্ধে অপহরণ, মানসিক ও শারীরিক নিগ্রহ এবং পকসো আইনে ( Protection of Children from Sexual Offences Act) মামলা রুজু হয়। উপযুক্ত সাক্ষ্যপ্রমাণ ও মেডিকেল রিপোর্ট-সহ চার্জশিট জমা দেওয়া হয় মাত্র ৩ দিনে।
সেই কেসেরই রায় বেরিয়েছে। কিশোরী মেয়েটিকে অপহরণের অপরাধে আজম আলির ৫ বছরের সশ্রম কারাদণ্ডের নির্দেশ দিয়েছেন মাননীয় বিচারক। সঙ্গে ১০,০০০ টাকা জরিমানা। জরিমানার ৯০% অর্থ ক্ষতিপূরণ বাবদ যাবে কিশোরী মেয়েটির কাছে। জরিমানা অনাদায়ে সশ্রম কারাদণ্ডের মেয়াদ বাড়বে আরও ৩ মাস। এরই পাশাপাশি পকসো আইনে আজমের ১০ বছরের সশ্রম কারাদণ্ডের নির্দেশও দিয়েছেন মাননীয় বিচারক। সঙ্গে ৫০,০০০ টাকা জরিমানা। এক্ষেত্রেও জরিমানার ৯০% অর্থ ক্ষতিপূরণ বাবদ যাবে কিশোরী মেয়েটির কাছে। জরিমানা অনাদায়ে কারাদণ্ডের মেয়াদ বাড়বে ৬ মাস। দুটি শাস্তিই বহাল থাকবে একসঙ্গে। চার্জশিট জমা দেওয়ার মাত্র ১৫ দিনের মধ্যে সম্পন্ন হয়েছে বিচার প্রক্রিয়া।