সুজিত চক্রবর্তী
আমাদের ভারত, ৫ মে: অতিমারীতে প্রায় স্তব্ধ মানুষের জীবনযাত্রা। সরকারি ও বেসরকারি উদ্যোগে ইতিমধ্যেই পুনর্নির্মাণের কাজ শুরু হয়েছে। মানুষের প্রাত্যহিক জীবনযাত্রা বজায় রাখতে অনেক বেসরকারি সেবা প্রতিষ্ঠান প্রত্যন্ত গ্রামীণ এলাকায় দরিদ্রদের রোজগারের জন্য নানা প্রকল্প শুরু করেছে। এমনই একটি সেবা প্রতিষ্ঠান “কর্মযোগী”। করোনা অতিমারীতে “কর্মযোগী”বিরামহীন সেবাকাজ করে চলেছে।
অতিমারীর আতঙ্কে সবাই যখন গৃহবন্দী দিন কাটাচ্ছেন,সেই সময়ই দুর্গতদের নিরলস ভাবে সেবা করে চলেছে স্বয়ংসেবী সেবা প্রতিষ্ঠান “কর্মযোগী”। রাজ্য ও রাজ্যের বাইরে ঘরবন্দী মানুষের হাতে খাদ্য ও অন্যান্য জিনিসপত্র তুলে দিয়ে কর্মযোগী এক অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করে চলেছে। দেশে লকডাউন শুরু হবার পর থেকেই এখনও পর্যন্ত রাজ্যের ১২টি জেলার ৫০টি জায়গায় প্রায় ১৫০০০ দুর্গতদের হাতে সাহায্য তুলে দিয়েছেন তাঁরা।এছাড়াও মুম্বাই, অসমের শিলচর ও বাংলাদেশের নড়াইল জেলায়ও সেবাকাজ চলেছে।
“কর্মযোগী”-র পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে,আগামী তিনমাস তাঁরা একই ভাবে অসহায় মানুষদের সেবা করে যাবেন।পাশাপাশি, করোনার কারণে কাজহারা মানুষদের কর্মসংস্থানের পরিকল্পনাও করা হয়েছে। পীড়িত পরিবারের মহিলাদের স্বনির্ভর করার কর্মসূচিও নেওয়া হয়েছে।কর্মসংস্থানের জন্য তাঁরা ইতিমধ্যেই খড়্গপুরের আইআইটি, কল্যাণী বিধান চন্দ্র কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের সাথে কথা বলেছেন।
গত ২০১৭ সালের সেপ্টেম্বরে “কর্মযোগী”-র পথ চলা শুরু হয়। রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘের স্বয়ংসেবকরাই “কর্মযোগী” তৈরি করেন। বর্তমানে “কর্মযোগী” সরকারি ভাবে স্বীকৃতি প্রাপ্ত একটি সেবা ট্রাস্ট। গ্রামীণ স্বনির্ভর প্রকল্প, অভাবী ও মেধাবী পড়ুয়াদের নিয়মিত বৃত্তি প্রদান, আদিবাসীদের জীবনযাত্রার মানোন্নয়ন ঘটানো, রক্তদান-বিনামূল্যে চিকিৎসা শিবির করা, পরিবেশ রক্ষা, বিজ্ঞানচেতনার প্রসার ঘটানো সহ বিভিন্ন কাজ করছে।
“কর্মযোগী” ও বাঁকুড়া জেলার “বাঁকাদহ শ্রীশ্রী রামকৃষ্ণ সারদা সেবাশ্রম” যৌথ উদ্যোগে গ্রামের দরিদ্র আদিবাসী পরিবারের আর্থিক সংস্থানের লক্ষ্যে কৃষিকাজ শুরু করেছে। দেড় বিঘা পতিত জমি চাষ যোগ্য করে তাতে আদা ও ওলের বীজ বপন করা হয়েছে। চাষের কাজে পরামর্শ দিতে এগিয়ে এসেছেন কল্যাণী বিধান চন্দ্র কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের কৃষিবিদ ডক্টর কল্যাণ চক্রবর্তী।
“বাঁকাদহ শ্রীশ্রী রামকৃষ্ণ সারদা সেবাশ্রম” ২০০৬ সালে পথচলা শুরু করে। ২০১০ সালের দানের জমিতে নিজস্ব সেবা ভবন তৈরি করে। আশ্রমের নিজস্ব শিশু বিদ্যালয়ে ১৯৫ জন ছেলেমেয়ে নিঃশুল্কে পড়ালেখা করে।এছাড়া, বিনাশুল্কে চিকিৎসা শিবির ও অন্যান্য সেবা প্রকল্প চলেছে সেবাশ্রমের উদ্যোগে।
বাঁকুড়া জেলার জেলাসদর বিষ্ণুপুরের মূল বাস স্ট্যান্ড থেকেই বাঁকাদহ গ্রামে যাবার বাস পাওয়া যায়।মেদিনীপুর বা জয়রামবাটী গামী যেকোনো বাসে উঠেই বাঁকাদহে নামতে হয়। সেখান থেকে দু’কিলোমিটার গেলে পাওয়া যাবে বৈতোল মোড়। বৈতোল মোড় থেকে আরও আধ কিলোমিটার গেলে কামার পাড়া গ্রাম। এই গ্রামেই “কর্মযোগী”-র চাষের প্রকল্প শুরু হয়েছে।
গ্রামটির তিনদিক ঘন অরণ্যে। ৯৫টি পরিবারের বাস। তার মধ্যে ২৫ টি পরিবার আদিবাসী। বাকি ৭০টি পরিবার তপশীলী জাতি। গ্রামে সরকারি প্রাথমিক বা উচ্চ বিদ্যালয় নেই। অনেকটা দূর হেঁটে গেলে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় পাওয়া যায়। গ্রামে বিদ্যুৎ নেই। পানীয় জলের ব্যবস্থা নেই।চাষের জন্য বৃষ্টির জলই ভরসা। স্বাস্থ্য কেন্দ্র নেই। নেই যোগাযোগের যানবাহনও। সাইকেলই ভরসা। একথায় গ্রামবাসীরা “নেই রাজ্যের বাসিন্দে”!
গ্রামের মানুষের জীবিকা মূলত গাছের পাতা সংগ্রহ। সামান্য চাষ যা হয়, তা বৃষ্টি নির্ভর। দিন-আনা-দিন-খাওয়া এই মানুষগুলো করোনার প্রভাবে খুবই অসুবিধায় পড়েছে। “কর্মযোগ” ও “সেবাশ্রম” যৌথ ভাবে এই অরণ্যবাসী মানুষদের আর্থিক ভাবে স্বনির্ভর করার জন্য উদ্যোগ নিয়েছে। মোট দেড় বিঘাতে আদা ও ওল লাগানো হয়েছে। এই প্রকল্প থেকে ১০টি আদিবাসী পরিবারের প্রায় ৫০ জন মানুষ উপকৃত হবেন। কর্মযোগীর পক্ষ থেকে বাঁকাদহ এলাকার দুর্গতদের খাদ্যদ্রব্য, পোষাক ও অন্যান্য সামগ্রী দেওয়া হয়েছে।
রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘের সহ প্রান্তীক বৌদ্ধিক প্রমুখ শিবাজী মণ্ডল বলেন, “খুব ভাল উদ্যোগ দেখলাম।”প্রান্ত সেবা প্রমুখ মনোজ চ্যাটার্জি কর্মযোগী’কে সাধুবাদ জানিয়ে বলেন, ‘কর্মযোগী’ শুরু থেকেই যে-ধরণের কর্মকান্ডে জড়িত তাতে আমি খুবই উৎসাহিত বোধ করি।”