স্বামী প্রৌঢ়ানন্দ
আমাদের ভারত, ২৮ নভেম্বর: ঐ গহন অন্ধকারে আশ্চর্য দৃশ্য দেখে কতক্ষণ নির্বাক হয়ে দাঁড়িয়ে ছিলাম খেয়াল নেই।হঠাৎ এক জলদ্গম্ভীর স্বরে আমার হুঁশ ফিরল। ঐ দীর্ঘ দেহী সন্ন্যাসী আমাকেই ডাকছেন, অবাক হয়ে গেলাম উনি তো আমাকে দেখেননি, তবে বুঝতে পারলেন কি করে যে আমি এখানে দাঁড়িয়ে আছি?
ধীরপায়ে সন্ন্যাসী মহারাজের দিকে এগিয়ে গেলাম। কিরে খুব অবাক হয়েছিস? আমিই তো তোকে ডাকতে পাঠিয়েছিলাম সর্পরাজকে দিয়ে। সন্ন্যাসী মহারাজের কথা শুনে সেই বিশাল সর্পটির দিকে তাকালাম, এটিই তাহলে আমার গায়ে উঠেছিল! এর প্রভাবেই রাস্তা ভুলকরে আমি এখানে এসে পৌছাঁলাম। মহারাজ হেসে বললেন তুই যা ভাবছিস ঠিক তাই। তোকে আমিই এখানে টেনে এনেছি, আমার উপর আদেশ হয়েছে তোকে বিশেষ কিছু যোগকৌশল শেখানোর। আমি অবাক হয়ে গেলাম। আমি এনাকে কোনওদিন দেখিনি, চিনি না অথচ উনি আমাকে যোগ কৌশল শেখাবেন বলছেন। আমার মনোভাব সন্ন্যাসী মহারাজ বুঝতে পেরে বললেন, তোর সাথে মায়ের মন্দিরে আমাদের বড় মহারাজের সঙ্গে দেখা হয়েছিল। উনি পূর্ব জন্মে তোর গুরুদেব ছিলেন। উনিই আজ এই বিশেষ যোগে তোকে যোগসাধনার কিছু গূঢ় রহস্য শেখানোর ভার আমাকে দিয়েছেন। মনে মনে বড় মহারাজজীকে প্রনাম জানালাম, “গুরু কৃপাহী কেবলম্।”
অন্ধকার খানিকটা চোখ সওয়া হতে সন্ন্যাসী মহারাজের মুখ দেখতে পেলাম, বয়স আন্দাজ করি চল্লিশের কাছাকাছি হবে। মুখের আকার গোলপ্রকৃতি। মহারাজ আমায় জিজ্ঞাসা করলেন, কিরে আমার বয়স খুব কম মনে হচ্ছে? আমি জোড় হাত করে বললাম হ্যাঁ মহারাজ, আপনাকে দেখে আমার চল্লিশ বছরের বলে মনে হচ্ছে।আমার কথায় মহারাজ হো হো করে হেসে উঠলেন, বললেন আমার বয়স প্রায় তিনশো বছর, আর আমাদের বড় মহারাজের বয়স প্রায় পাঁচশো বছর হয়ে গেছে। শুনে আমি হতবাক হয়ে গেলাম। মহারাজ বুঝতে পেরে বললেন, জানি তোর বুঝতে একটু কষ্টহবে, কিন্তু যোগের দ্বারা বয়সকে আমরা থমকে রাখতে পারি। এই সমস্ত গূঢ় তত্ত্ব পৃথিবী থেকে হারিয়ে যেতে বসেছে, ভালো আধার না থাকার কারনে। তাইত বড় মহারাজ আমাকে পাঠিয়েছেন, এই গুপ্ত যোগের কিছু প্রাথমিক পাঠ তোকে শেখানোর জন্য। নে আর দেরী করিস না, তাড়াতাড়ি ঐ সামনের আসনে বসে পর। এতক্ষণ খেয়াল করিনি, এবার লক্ষ্য করলাম সামনে একটা আসন পাতা আছে, দেরী না করে সেখানে গিয়ে বসলাম।
সন্ন্যাসী মহারাজ আমাকে প্রথমেই কপালে একটা ভস্ম তিলক কেটে দিলেন। এরপর আমাকে চোখ বুজে তিনবার ওম উচ্চারণ করতে বললেন। তিনবার ওম উচ্চারণ শেষ হতে না হতেই আমার আজ্ঞাচক্রে এক সূচ ফোটানো যন্ত্রণা অনুভব করলাম, মনেহল মহারাজ আমার আজ্ঞাচক্রে কিছু ফোটালেন। কিন্তু এই ঘটনার পরমুহূর্তেই আমার মনে হল আমি আর সেই অন্ধকার জঙ্গলে নেই, পরিবর্তে আমি বসে আছি এক তূষার আবৃত স্থানে। চারদিকে বরফের পাহাড়, কিছুটা দুরে একটা নদীর স্রোত, আশ্চর্যজনক ভাবে নদীর জল কিন্তু জমে বরফ হয়ে যায়নি। আরও আশ্চর্য এই তুষারাবৃত জায়গাতেও কিন্তু খুব ঠান্ডা অনুভব করছি না।আমি বরফে উপর একটি আসনে বসে আছি, আর আমার সামনেই রয়েছেন সন্ন্যাসী মহারাজ। বেশ কয়েকটি আসন এবং মূদ্রা তিনি দেখিয়ে দিলেন এবং আমাকে দিয়েও করালেন। যতক্ষণ না আমি সঠিক ভাবে উনাকে আসনগুলি করে না দেখালাম উনি আমাকে ছাড়লেন না।সঠিক ভাবে সব কটি আসন দেখাবার পরে উনি আমার মাথায় হাত দিয়ে আশীর্বাদ করলেন। বললেন সবসময় সত্য পথে চলবি। সত্য কে ধরে থাকলে সব কিছুই পাবি। অসত্য পথ হয়তো ক্ষনিকের জন্য আনন্দ দিতে পারে কিন্তু অন্তে সে পথ দুঃখে ভরা। এই যে আসনগুলি দেখালাম এইগুলি ঠিক ঠিক ভাবে করবি। আর আমাদের বড় মহারাজের আদেশ তুই সংসার ত্যাগ করবি না। তোকে সমাজ সংসারে অনেক বড় কাজ করতে হবে।অনেক ঝড় ঝাপটা আসবে সেই সমস্ত ঝড় ঝাপটা সামলাতে এই আসনগুলোই তোকে সাহায্য করবে, তোর মানসিক শক্তি বৃদ্ধি করবে। আমি জিজ্ঞাসা করলাম, বাবা এই জায়গাটি কোথায়? সন্ন্যাসী মহারাজ স্মিত হেসে জবাব দিলেন এটা কৈলাস পর্বতের আরো উত্তর দিকের স্থান। কোনও সাধারন মানুষের পক্ষে এখানে আসা সম্ভব নয়। একমাত্র এখানকার বড় মহারাজের ইচ্ছা হলেই তবে এ স্থানে আসা যায়। এখানকার বায়ুস্তর খুব পাতলা, শ্বাসকার্য চালানো এখানে খুবই কঠিন।এখানে কারা থাকেন? আমি আবার প্রশ্ন করলাম। এখানে খুবই উচ্চ কোটির মহাপুরুষেরা থাকেন। এখানেও অনেকগুলি স্তর আছে, এক একটি স্তরে এক একজন মহাপুরুষ বাস করেন। তাঁরা প্রতিনিয়ত মানব তথা জগতের কল্যানের জন্য কাজ করে চলেছেন। কিন্তু তোর এখানে থাকার সময় প্রায় ফুরিয়ে এসেছে। এখান থেকে তোকে এবার চলে যেতে হবে। কিন্তু এখানে এসেছি যখন তখন একবার বড়মহারাজকে দেখতে পাব না? আমি করজোড়ে সন্ন্যাসী মহারাজ কে অনুরোধ করলাম। মহারাজ আমার দিকে খানিকক্ষণ তাকিয়ে কি ভাবলেন, তারপর বললেন ঠিক আছে দেখবি তবে দূর থেকে কাছে যেতে পারবি না।তবে মনে রাখবি তোর এখানে থাকার মেয়াদ কিন্তু খুব কম।এই বলে মহারাজ আমাকে চোখ বুঝতে বলে আমার একটা হাত ধরলেন। খানিকটা পরে চোখ খুলতে বললেন। চোখ খুলে দেখি বেশ খানিকটা দূরে বড়মহারাজজী ধ্যানস্থ হয়ে বসে আছেন, তাঁর চারিদিকে একটা কুয়াশার বলয় ঘিরে রেখেছে। আর সেই বলয় ভেদ করে বেরিয়ে আসছে এক অপূর্ব আলোকজ্যোতি। কতক্ষণ এই অপরূপ সুন্দর দৃশ্য উপভোগ করছিলাম খেয়াল নেই, হঠাৎ ঐ আলোকশিখা আমার মধ্যে এসে প্রবেশ করল আর আমি জ্ঞান হারালাম।