আমাদের ভারত, ২১ ডিসেম্বরে: শ্রীরামকৃষ্ণের কল্পতরু হওয়ার দিনক্ষণের বর্ণনা পাই অক্ষয়কুমার সেন প্রণীত ‘শ্রীরামকৃষ্ণ-পুঁথি’র অন্ত্যলীলায়— “আঠারশো ছিয়াশির সাল গণনায়। বিশেষতঃ দিন ইহা প্রভুর লীলায়।।
প্রথম দিবস আজি নব বরষেতে। একাদশী তিথি আজি হিন্দুদের মতে।।”
১৮৮৬ সালের পয়লা জানুয়ারি, এক একাদশী তিথিতে শ্রীরামকৃষ্ণ পরমহংসদেব কল্পতরু হয়েছিলেন। বেলা তৃতীয় প্রহর। চিকিৎসার প্রয়োজনে কাশীপুরে বসবাস করছিলেন এক বাগান-বাড়িতে। সেদিন ভবনের দ্বিতল থেকে নিম্নতলে নেমে এলেন তিনি, এলেন উদ্যানের পথে।
“গগনে যখন বেলা তৃতীয় প্রহর। নিম্নতলে নামিলেন কৃপার সাগর।”
ডাক্তারের বিধান অনুযায়ী স্থান পরিবর্তনের জন্য কলকাতার কাশীপুরে আনা হয়েছিল। তা এক বিরাট বাগান, ভিতরে সুন্দর দ্বিতল বাড়ি। চারিদিকে বহু ফুলের গাছ, ফলের গাছ; দু’টি পুষ্করিণী, তাতে শানে বাঁধা ঘাট। বাগানের পাশ দিয়ে কোম্পানির বড় পথ। মাসে চার কুড়ি টাকা ভাড়া। ঠাকুরেরও পছন্দ হয়েছিল এই বাড়ি। “পাছু পাছু আসিলেন মাতা ঠাকুরানী,” স্বতন্ত্র মহলে বাসা নিলেন সারদাদেবী, ঠাকুরের ছায়ার মতন সঙ্গ নিলেন ভক্ত-মা। একপাশে পাকশালার বেড়া, মায়ের মহল পূর্ব দিকে পৃথক। দ্বিতল বাড়ির দ্বিতলভাগে ঠাকুরের পৃথক আসন, নিম্নতলে রইলেন অন্তরঙ্গ ভক্তবৃন্দ। তাদের মধ্যে নরেন্দ্র, রাখাল, কালী, নিত্যরঞ্জন, যোগীন, শরৎ, শশী, বলরাম বসুর শ্যালক বাবুরাম, মুরব্বি গোপাল, তারক ঘোষাল এবং লাট্টু — “তিয়াগিয়া ঘরবাড়ি একটানে থাকে।/ কানেও না শুনে যত আত্মীয়েরা ডাকে।” মাঝে মাঝে ডাক্তার আসেন তাদের মাঝে। চিকিৎসায় ‘ঔষধ-বিধানে’ ঠাকুরের স্বাস্থ্যের উন্নতি হতে থাকে, পূর্বাপেক্ষা অঙ্গে বলের সঞ্চার হয়। ঠাকুর মাঝে মাঝে উদ্যানে নেমে এসে বিহার করেন। গোটা বাড়িতে সর্বদা আনন্দের উচ্চরোল, গীতবাদ্যে যেন ফেটে পড়ছে। এই বাগানবাড়িতেই তিনি কল্পতরু হলেন —
“নববর্ষে অপরূপ রূপে পরমেশ। ভবনে বিরাজমান কল্পতরুবেশ।।” বাগানে ভ্রমণ করবেন বলে সেদিন উদ্যানের পথে নেমে এলেন ‘জগৎ-গোসাঁই’, সভক্তে বিহারে বের হলেন। সেদিন তাঁর সাজসজ্জা কেমন ছিল, তার বিবরণ পাওয়া যায় —
“আজি মনোহর বেশ প্রভুর আমার।
বারেক দেখিলে কভু নহে ভুলিবার।।
পরিধান লালপেড়ে সুতার বসন।
গায়ে বনাতের জামা সবুজ বরন।।
সেই কাপড়ের টুপি কর্ণমূল ঢাকা।
মোজা পায়ে চটি জুতা লতাপাতা আঁকা।।
শ্রীঅঙ্গের মধ্যে খোলা বদনমণ্ডল।
কান্তিরূপে লাবণ্যেতে করে ঝলমল।।”
তবুও দেখা গেল বয়ানেতে নিরন্তর ক্লান্তি; অথচ রূপে সৌন্দর্যের ছটা। অক্ষয়কুমার লিখছেন, “মনে হয় অঙ্গ-বাস সব দিয়া খুলি। নয়ন ভরিয়া দেখি রূপের পুতুলি।”
সেদিন যাঁরা ঠাকুর দর্শন পেয়েছিলেন তাঁদের নাম রয়েছে পুঁথিতে। যেমন হরিশ মুস্তফী (বঙ্গজ- ব্রাহ্মণ, দেবেন্দ্রের মামা), দেবেন্দ্র (তাঁর অন্তরঙ্গ ভক্ত), হরিশ্চন্দ্র, অক্ষয়কুমার সেন নিজে, গিরিশচন্দ্র ঘোষ, নবগোপাল, উপেন্দ্র মজুমদার, রামচন্দ্র, শ্রীহরমোহন, গাঙ্গুলি উপাধিধারী রাঁধুনী ব্রাহ্মণ, প্রতাপচন্দ্র হাজরা, নরেন্দ্রনাথ, মহেন্দ্র ডাক্তার (মহেন্দ্রলাল সরকার), রাজেন্দ্র দত্ত (বহুবাজারের সুবিজ্ঞ ডাক্তার) প্রমুখ।
সেবাপর ভক্তগণ পিছু পিছু তাঁর সাথে ছিলেন। সেদিন তাঁর কৃপাসিন্ধু উথলে উঠেছিল। বাগানে উপস্থিত যত দীন দুঃখী কানা খোঁড়া ছিল, তাদের সবার কথা মনে পড়ে গেল ঠাকুরের, কৃপা করলেন।
ভক্তরা সেদিন ঠাকুরের কাছ থেকে কী পেয়েছিলেন, তার উল্লেখ আছে পুঁথিতে —
“কৃপা নহে কড়ি পাতি নহে রাজ্যধন। কিংবা নহে মনোহর কামিনী-কাঞ্চন।।
সুস্বাদু ভোজন নয় নয় গাঁজা সুরা।
নহে মাদকীয় কিছু ক্ষণানন্দধারা।।
তথাপি কৃপার মধ্যে হেন বস্তু আছে।
তুলনায় যাবতীয় রাজ্যধন মিছে।।
কৃপায় আনন্দরাশি বহে শতধার।
ধন্য সে আধার যাহে কৃপার সঞ্চার।।”
সেদিন অক্ষয়কুমার সেন প্রভুর পাদপদ্মে দু’টি জহরিয়া চাঁপা ফুল অর্পণ করেছিলেন,
“দাঁড়াইনু একধারে প্রভুর পশ্চাতে।
জহরিয়া চাঁপা দুটি ছিল দুই হাতে।।…
পদপ্রান্তে গিয়া মুই এমন সময়ে।
তোলা দুটি চাঁপা ফুল দিনু দুটি পায়ে।”
সেদিন অপরাহ্নে তিনি কয়েকজন ভক্ত,বন্ধু মিলে গাছের উপরে ডালে বসে ‘বানর বানর’ খেলছিলেন। এদিকে গিরিশ ঘোষ জানু পেতে করজোড়ে প্রভুর পদমূলে বসে আছেন। প্রভু পথের উপর সমাধিস্থ।
‘শ্রীরামকৃষ্ণ-পুঁথি’র লেখক অক্ষয়কুমার সেনকে স্বামী বিবেকানন্দ আদর করে রহস্যপূর্বক ‘শাঁকচুন্নি মাস্টার’ নামে ডাকতেন। হয়তো তাঁর ঘনকৃষ্ণ বর্ণ, মধ্যমাকৃতি চেহারা এবং রুগ্ন শরীরের জন্যই এই নাম হতে পারে! কলকাতায় ঠাকুর বাড়িতে বালকদের তিনি পড়াতেন, সেখানে তাঁর পরিচয় ছিল ‘অক্ষয় মাস্টার’। তাঁরই অক্ষয় কীর্তি ‘শ্রীরামকৃষ্ণপুঁথি’। এই পুঁথির ভূয়সী প্রশংসা করেছিলেন স্বামী বিবেকানন্দ। শ্রীমা সারদাদেবীর আশীর্বাদও ছিল অক্ষয়কুমারের প্রতি। একবার কামারপুকুরের গ্রামবাসীদের আহ্বান করে এই পুঁথি অক্ষয়কে দিয়ে পড়িয়ে শুনিয়েছিলেন। এই গ্রন্থ রচনার উপাদান তিনি সংগ্রহ করেছিলেন দেবেন্দ্রনাথ, গিরিশচন্দ্র, স্বামী যোগানন্দ, স্বামী নিরঞ্জনানন্দ এবং স্বামী রামকৃষ্ণানন্দের কাছ থেকে৷
শ্রীরামকৃষ্ণ সম্পর্কে অক্ষয়ের ছিল অপরিসীম বিশ্বাস ও ভক্তি। স্বামীজী চেয়েছিলেন অক্ষয়কুমার যেন ঘরে ঘরে শ্রীরামকৃষ্ণের পূজা করান। এই পূজার অধিকার ব্রাহ্মণ, চণ্ডাল, মেয়ে, পুরুষ সবাই যেন পায়। সত্যযুগে ঠাকুরের প্রেমের বন্যায় সব একাকার হয়ে যাবে। সব ভেদাভেদ উঠে যাবে, আচণ্ডাল প্রেম পাবে, এই ছিল ইচ্ছে৷ স্বামীজী চেয়েছিলেন, “মহোৎসবে শাঁকচুন্নির পুঁথি সকলের সামনে যেন পড়ে।.. শাঁকচুন্নি ঐ পুঁথি সকলকে শোনাক।” কী কী বিষয় আছে এই পুঁথিতে?
গ্রন্থের প্রথম খণ্ডের আলোচ্য বিষয় হচ্ছে শ্রীরামকৃষ্ণের জন্মকথা; শিবের আবেশ; আপন ঐশ্বর্য প্রদর্শন; রঘুবীরের মালাগ্রহণ; হনুমানের সঙ্গে খেলা; গোচারণ; পাঠশালায় অধ্যয়ন; চিনুশাঁখারীর মিষ্টি ও মালা গ্রহণ; বিশালাক্ষীর আবেশ; পুথি-লিখন; কালীপুজো, রমণীর বেশধারণ এবং খেলাচ্ছলে আসন-প্রদর্শন ইত্যাদি।
দ্বিতীয় খণ্ডে উল্লেখ আছে কলকাতায় ঠাকুরের আগমন; পুরী প্রতিষ্ঠা, প্রবেশ এবং রানী ও মথুরের সঙ্গে পরিচয়; বিবাহ; তান্ত্রিক-সাধনা; রামাৎ-সাধনা; মথুরকে শিবকালী-রূপ-প্রদর্শন; রাসমণির পরীক্ষা; যোগ-সাধনা, মধুরভাবে সাধনা, ইসলাম-সাধনা, খ্রীষ্টানের-সাধন; ভাব-প্রদর্শন, স্বদেশ-যাত্রা এবং তীর্থ-পর্যটন।
তৃতীয় খণ্ডে রয়েছে পেনেটির মহোৎসবে আগমন, কলুটোলায় চৈতন্য-আসন গ্রহণ; হৃদয়ের দুর্গোৎসব, মথুরের দেহত্যাগ; মাতাদেবীর দক্ষিণেশ্বরে আগমন; ষোড়শীপূজা; মাইকেল মধুসূদনের শ্রীরামকৃষ্ণ-দর্শন; ডাকাত বাবার কথা; কেশবচন্দ্রকে কৃপাদান, প্রভুদর্শনে কেশবের দক্ষিণেশ্বরে আগমন, কেশবের শক্তিরূপ-দর্শন, কেশবকে বিশ্বপ্রেমের উপদেশ এবং আত্মপ্রেম প্রদর্শন; লক্ষ্মীমাড়োয়ারীর অর্থদান-প্রার্থনা এবং বহু অন্তরঙ্গের আগমন প্রভৃতি বিষয় বর্ণনা।
চতুর্থ খণ্ডে রয়েছে প্রভুর সঙ্গে রাখালের মিলন, নিত্যনিরঞ্জনের মিলন; সুরেন্দ্র, মনোমোহন ও রাজেন্দ্রের ঘরে প্রভুর মহোৎসব; নরেন্দ্রের মিলন, মহেন্দ্র মাস্টারের আগমন, ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের সঙ্গে কথোপকথন, শশধর তর্কচূড়ামণির সঙ্গে কথা; সিঁথির ব্রাহ্ম সমাজে প্রভুর গমন; নীলকণ্ঠের যাত্রাশ্রবণ; শ্যামাপদ ন্যায় বাগীশের দর্পচূর্ণ; নবগোপাল ঘোষের বাড়িতে উৎসব, দেবেন্দ্রের গৃহে উৎসব; ভদ্রকালী গ্রামে প্রভুর আগমন; ভক্তদের সঙ্গে প্রভুর পানিহাটি মহোৎসবে গমন, মাহেশের রথে আগমন বিষয়ক অধ্যায়।
পঞ্চম খণ্ডে আছে শ্রীরামকৃষ্ণের চিকিৎসার জন্য কলকাতায় আগমনের কথা, সেখানে বসবাস, সুরেন্দ্রের গৃহে দুর্গাপূজায় তাঁর অলক্ষ্যে আবির্ভাব; মহেন্দ্র ডাক্তারের সঙ্গে তাঁর রঙ্গ, উপদেশ, ভাবের বাজার প্রদর্শন; তাঁর কালীপূজা; কাশীপুরে স্থান পরিবর্তন, অন্তরঙ্গ-বাছাই, ভক্তদের বাসনাপূরণ এবং তাঁদের নিয়ে মঠস্থাপনের কথা।
অক্ষয়কুমার সেনের জন্ম বাঁকুড়া জেলার ময়নাপুর গ্রামে; পিতা হলধর, মাতা বিধুমুখী দেবী। তিনি জোড়াসাঁকো ঠাকুর বাড়িতে গৃহশিক্ষক হিসাবে নিযুক্ত ছিলেন। শ্রীরামকৃষ্ণ-পার্ষদ দেবেন্দ্রনাথ মজুমদারও ঠাকুর বাড়িতে তখন নিযুক্ত। অক্ষয় ঠাকুরের নামে আকৃষ্ট হলেন, তাই তাঁর সামীপ্যে পৌঁছাতে দেবেন্দ্রনাথের সহায়তা পেতে চেষ্টা করলেন। সে সুযোগ একদিন এসে গেল। কাশীপুরে ভক্ত মহিম চক্রবর্তী তাঁর আপন গৃহে শ্রীরামকৃষ্ণের পদার্পণ উপলক্ষে এক মহোৎসবের আয়োজন করলে দেবেন্দ্রনাথ সেখানে আমন্ত্রিত হন। তাঁরই সহায়তায় অক্ষয়কুমারও সেখানে যাবার অনুমতি পেলেন এবং প্রভুর লীলাদর্শনে কৃতকৃতার্থ হলেন। কাশীপুরের ‘কল্পতরু’ দিবসে তিনি সবান্ধব উপস্থিত থেকে ঠাকুরের অসীম কৃপালাভ করেন। ঠাকুর তাঁদের উদ্দেশ্যে দক্ষিণ হস্ত উত্তোলন করে আশীর্বাদ করেন, “তোমাদের চৈতন্য হোক”। ঠাকুরের মহাসমাধির দিন তিনি নরেন্দ্রর কথামতো রাতে কাশীপুরে থেকে গিয়েছিলেন। ঠাকুরের লীলাসংবরণের অবস্থা দেখে গভীর রাতে তিনি কলকাতায় গিয়ে গিরিশ ঘোষ ও রামচন্দ্র দত্তকে ডেকে আনেন। একসময় ‘বসুমতী’ পত্রিকা অফিসে তিনি কাজ করেছেন৷ শেষ বয়সে নিজের গ্রামের বাড়িতে চলে যান। ১৯২৩ সালের ৭ ই ডিসেম্বর তিয়াত্তর বছর বয়সে তাঁর প্রয়াণ ঘটে।
তথ্যসূত্র:
১. শ্রীরামকৃষ্ণ-পুঁথি, অক্ষয়কুমার সেন, ষষ্ঠ সংস্করণ মে, ১৯৬১, ২৪ তম পুনর্মুদ্রণ, জুলাই, ২০২৩; উদ্বোধন কার্যালয়, পৃষ্ঠা: ৬১৩- ৬১৭
২. শ্রীরামকৃষ্ণ ভক্ত-মালিকা: অখণ্ড, স্বামী গম্ভীরানন্দ, অখণ্ড সংস্করণের (২০০৫) ১৭ তম পুনর্মুদ্রণ জানুয়ারি ২০২৪, উদ্বোধন কার্যালয়, কলকাতা, পৃষ্ঠা: ৫৯২-৫৯৬
*(ছবি: শীর্ষ আচার্য)*

