জয় লাহা, দুর্গাপুর, ১ সেপ্টম্বর: আইন তুমি কার! মোটা টাকার মাসোহারায় বিকিয়ে যাচ্ছে বিধান। গ্রিন ট্রাইবুনালের নির্দেশিকাকে বুড়ো আঙ্গুল দেখিয়ে রাতের অন্ধকারে বর্ষাকালেও অবৈধ উপায়ে অজয়, দামোদরে চলছে অবাধে বালি পাচার। ঠান্ডা পানীয়তে বিকিয়ে যাচ্ছে লোকাল সোর্স। নিরবে কোটি কোটি টাকার প্রাকৃতিক সম্পদ অবাধে চলছে লুটতরাজ। এমনই নজির বিহীন বালি মাফিয়ারাজ চলছে অজয় ও দামোদর নদে।কাঁকসার অজয় নদে বনকাটি, দেউল, সাতকাহানিয়া ও দামোদরে আইমা, সিলামপুর ঘাট এভাবেই চলছে বালি চুরি।
দামোদর নদ বাঁকুড়া জেলার আওতায়। নদীর এপার পূর্ব ও পশ্চিম বর্ধমান জেলার আওতায়।
বাঁকুড়া থেকে নদীর এপারে অভিযানে আসতে কমপক্ষে দেড় থেকে দু’ঘন্টা সময় লাগে।
প্রশানিক নজরদারিতে যখন পৌঁছায়, ততক্ষণে সব পগারপাড়। এই সুযোগকে হাতিয়ার করে বালি মাফিয়াদের রমরমা কারবার।

বাঁকুড়া জেলাপ্রশাসন জানিয়েছে, বর্ষায় দামোদরে কোনোরকম বালি তোলার অনুমতি নেই। তারপরও আইনকে বুড়ো আঙ্গুল দেখিয়ে দামোদর নদের ওপর সিলামপুর, আইমা, শাঁকুড়ি, শালডাঙা ও মন্সিপুর ঘাটে অবাধে চলছে অবৈধভাবে বালি উত্তোলন। কাঁকসার সিলামপুর, আইমাঘাটে রাতের অন্ধকার নামতে নির্বিচারে চলছে জেসিবি, পোকলেন মেশিন দিয়ে বালি তোলার কাজ। মাসখানেক আগে খবর প্রকাশিত হতেই বন্ধ ছিল বালি তোলার কাজ। তারপর নিম্নচাপের রেশ কাটতেই গত ৫-৬ ধরে আবারও শুরু হয় বালি পাচারের রমরমা কারবার। মূলত দামোদর নদে সোনামুখির ডিহিপাড়া ও পলাশডাঙা মৌজায় রাত ১০ টার পর চলছে অবাধে বালি তোলার কাজ। ওই দুই মৌজা থেকে কমপক্ষে ১০০ টি ট্রাক্টর ৭০ টি ডাম্পারে চলছে বালি পাচার। একইরকমভাবে অজয় নদের ওপর কাঁকসার সাতকাহানিয়া, বাঁশতলা শ্মশানঘাট, জঙ্গলঘাট, দেউল ঘাট, পেয়ারাবাগান ঘাটে চলছে অবাধে অবৈধভাবে বালি উত্তোলন। দশ চাকা থেকে ১৬ চাকার লরি ডাম্পার, ট্রাক্টরে বালি বোঝাই হয়ে গ্রামের রাস্তা দিয়ে অবাধে যাতায়াত করছে। আর তার ফলে গ্রামে কংক্রিটের রাস্তার অচিরেই ভেঙ্গে পড়ছে। যাতায়াতের সমস্যায় পড়ছে সাধারণ মানুষ থেকে স্কুল পড়ুয়ারা। দামোদরের সিলামপুর, আইমা ঘাটে রাত ১০ টার পর ওইসব বালি বাঝোাই লরি, ডাম্পার পানাগড়ের ওপর দিয়ে উঠছে জাতীয় সড়কে। তারপর সোজা চলে যাচ্ছে কলকাতায়। এছাড়াও দিনে দুপুরে ৪০-৫০ ট্রাক্টর বিভিন্ন ঘাট থেকে বালি সরবরাহ করছে। ট্রাক্টর বোঝাই ওইসব বালি পানাগড় সিলামপুর রোডের পাশে ও পানাগড় ক্যানেলপাড়ে মজুত করা হচ্ছে। আবার সাতকাহানিয়া এলাকায় দিনভর ৩৫ টি ট্রাক্টরে বালি পাচার হচ্ছে। সেখানের জঙ্গলে ও মিলের মাঠে মজুত করা হচ্ছে বালি। সুযোগ বুঝে সেখান থেকে মজুত বালি লরি, ডাম্পারে পাচার হচ্ছে অন্যত্র। কয়েকদিন আগে মুখ্যমন্ত্রী জেলাপ্রশাসনকে কাঁকসা ও বুদবুদের ওপর নজর দেওয়ার নির্দেশ দিয়েছেন। নির্দেশিকাই সার। দুই জেলার কাঁকসা থানা এলাকা মাফিয়াদের স্বর্গরাজ্য। অবাধে চলছে অবৈধ বালি পাচারের রমরমা কারবার। লোকসান হচ্ছে রাজ্যের কয়েক কোটি টাকার রাজস্ব। বেপরোয়া অবৈধ বালি বোঝাই গাড়ি যাতায়াতে ভেঙ্গে পড়ছে গ্রামের রাস্তা। অতিষ্ট সাধারণ পথচলতি মানুষ থেকে স্কুল পড়ুয়া। ক্ষোভ বাড়ছে এলাকায়। দিনভর গ্রামের রাস্তায় বেপরোয়া ট্রাক্টর যাতায়াতে ঘুম ছুটেছে এলাকাবাসীর। বাসিন্দাদের অভিযোগ, গ্রামের রাস্তায় যেভাবে বালির গাড়ি যাতায়াত করছে, তাতে বড় ধরনের যে কোনো সময় দুর্ঘটনা ঘটতে পারে। পাড়ার রাস্তায় অনেক সময় ছেলেমেয়ের খেলাধুলা করে। তাতে অসাবধানে দুর্ঘটনার আশঙ্কা রয়েছে। সবক’টি বালি ঘাটের রাস্তার ওপর প্রাইমারি ও হাইস্কুল রয়েছে। গ্রামের একমাত্র সদর রাস্তা। তাই স্কুল পড়ুয়া থেকে সাধারন মানুষের সবসময় যাতায়াত। বেপরওয়া বালির লরি, ডাম্পার যাতায়াতে আতঙ্কিত এলাকাবাসী। আর অবৈধ বালি উত্তোলনের জেরে বদলে যাচ্ছে নদীর গতিপথ। ভেঙ্গে পড়ছে নদীর পাড়। বিপন্ন হচ্ছে কৃষিজমি। বর্তমানে দামোদরের গ্রাসের মুখে পশ্চিম বর্ধমান জেলার দামেদর নদ তীরবর্তী কাঁকসা ব্লকের সিলামপুর, আইমা, এলাকার চাষজমি। চরম আতঙ্কে গ্রামবাসীরা। আর নদী ভাঙ্গনের কারণ হিসাবে অবৈধ উপায়ে বালি উত্তোলনকে দুষছে এলাকাবাসীরা। শালডাঙা গ্রামের বাসিন্দারা জানান, “যেভাবে অবৈধ উপায়ে বালি উত্তোলন হচ্ছে, তাতে দামোদরের গ্রাসের মুখে এক হাজারেরও বেশি চাষজমি। বছরখানেকের মধ্যে নদী ভাঙ্গনে তলিয়ে যাবে। পাশাপাশি রনডিহা জলাধারে প্রভাব পড়বে।” সিলামপুর গ্রামের বাসিন্দারা জানান, “মাঝ নদীর বালি তুলতে গিয়ে বালি কারবারিরা নদীর জলস্রোতের গতিপথ ঘুরিয়ে দিচ্ছে। বালির বাঁধ তৈরী করে জলস্রোত নদীর পাড় দিয়ে ঘোরানো হচ্ছে। ফলে জলস্রোতে কবলে ভাঙ্গছে নদীর পাড়। যেভাবে নদীপাড় ভাঙ্গছে, তাতে বহুচাষজমি, ঘরবাড়ি অচিরে তলিয়ে যাবে। বহুবার প্রশাসনকে জানানো হয়েছে। সুরাহা হয়নি।” বর্ষাকালে নদীগর্ভে দুর্ঘটনা ঠেকাতে বালি উত্তোলনে গ্রিন ট্রাইবুনালের কড়া নিষেধাজ্ঞা রয়েছে। তাছাড়াও গত জুন মাসের মাঝামাঝি দামোদরে ডিহিপাড়া, পলাশডাঙা মৌজায় বৈধ বালি উত্তোলনের মেয়াদ শেষ হয়ে গেছে। তারপরও কিভাবে চলছে বালি তোলার কাজ? অবৈধ বালি পাচারে কোটি কোটি টাকার সরকারের রাজস্ব লোকসান হচ্ছে। তারপরও রাতের অন্ধকারে কাদের মদতে চলছে অবৈধভাবে বালি উত্তোলন? ভূমি রাজস্ব দফতরের নজরদারি নিয়ে উঠছে প্রশ্ন।
স্থানীয় বিজেপি নেতৃত্বের অভিযোগ, “পুলিশ প্রশাসন ও তৃণমূলের মদতে চলছে বালি পাচারের রমরমা কারবার। ঠান্ডা পানীয়তে বিকিয়ে যাচ্ছে লোকাল সোর্স। এক কথায় মোটা টাকার মাসোহারায় বিকিয়ে যাচ্ছে প্রাকৃতিক সম্পদ। তৃণমূলের পঞ্চায়েত সদস্য থেকে প্রধানের স্বামী বালি পাচারে জড়িত। তাদেরই ট্রাক্টর, ডাম্পারে বালি পাচার হয়। অবৈধ বালি পাচার বন্ধে কতিপয় অভিযোগ দায়ের করেছে অল ইন্ডিয়া অ্যান্টি করাপশেন অর্গানাইজেশন।
সংগঠনের পক্ষে সুব্রত মল্লিক জানান, “সর্ষের মধ্যে ভূত লুকিয়ে থাকলে ভূত তাড়ানো মুশকিল। পুলিশের মদতে চলছে অবাধে বালি লুট। দুই জেলার দুই থানার পুলিশের সঙ্গে বালি মাফিয়াদের মাসোহারার গোপন আঁতাত রয়েছে। এমনকি পুলিশের লোকাল সোর্সও ঠান্ডা পানীয় আর নামমাত্র টাকায় বিকেয়ে যাচ্ছে। লোকসান হচ্ছে রাজ্যের কয়েক কোটি টাকার রাজস্ব। বদলে যাচ্ছে নদীর চরিত্র। এসব বন্ধ হওয়া দরকার।”
সিলামপুর এলাকায় কয়েকজন ট্রাক্টর চালাক মুখ ফসকে স্বীকারও করে নেয়, দৈনিক ৪০০ টাকা করে লোকাল ট্যাক্স মানে বখরা দিতে হয়। দামোদরের সিলামপুর, আইমা ঘাটে ট্রাক্টর পিছু ৬-৮ হাজার টাকা ও ডাম্পার পিছু ১৫-২০ হাজার টাকা মাসোহারা রেট রয়েছে। একইরকমভাবে অজয় নদের ওপর কাঁকসার বনকাটি, সাতকাহানিয়া, দেউল ও জঙ্গলঘাটে মাসোহারা রেট বাঁধা রয়েছে। গত বুধবার রাত ১২ টা নাগাদ খবর পেয়ে আচমকা সিলামপুর ঘাটে হানা দেয় বাঁকুড়া জেলা প্রশাসন। কিন্তু, তাদের কনভয় ঢোকার আগে ঘন্টাখানেকের মধ্যে পগারপাড় হয়ে যায় বালি মাফিয়ারা। গাড়ি নিয়ে চম্পট দেয় ডাম্পার চালকরা। অভিযোগ, মাফিয়াদের কিছু বেতনভোগী সোর্স রয়েছে। যারা দুর্গাপুর ব্যারেজ, পানাগড় রেলপার এলাকায় দিবারাত্রি নজরদারি রাখে। এমনকি সিলামপুর আইমা রোডে মোটরবাইক নিয়ে টহল দেয় মাফিয়াদের ওইসব গুপ্তচর। পরিস্থিতির আগাম সতর্ক করে জানিয়ে দেয় তারা। প্রশাসনিক গাড়ী ঢোকার আগাম খবর পৌঁছে দেয়। আর তাতেই সতর্ক হয়ে যায় বালি মাফিয়ারা। বাঁকুড়া জেলাশাসক এ. রাধিকা জানান,”অবৈধ বালি উত্তোলন কোনভাবেই বরদাস্ত করা যাবে না। ওই এলাকায় অভিযান চালিয়ে সরাসরি ধরপাকড় কঠিন হয়ে পড়ছে। পৌঁছানোর আগে, সরে যাচ্ছে বালি পাচারকারীরা। তবুও বিষয়টি দেখা হচ্ছে।”
পশ্চিম বর্ধমান জেলা পরিষদের সহ সভাপতি সমীর বিশ্বাস জানান,
“রাজ্যে আর্থিক সঙ্কট রয়েছে। তার মধ্যে এভাবে রাজস্ব ফাঁকি দিয়ে বালি চুরি বরদাস্ত করা যাবে না। বিষয়টি নিয়ে জেলা প্রশাসনের সঙ্গে আলোচনা করা হবে। আইন আইনের পথে চলবে।”

