আমাদের ভারত, বাঁকুড়া, ১৫ জানুয়ারি: বাঁকুড়ায় জল সঙ্কট সত্ত্বেও জলের অপচয় সমানে চলেছে। ২০২৪ সালে জেলাবাসীর জল কষ্টের তিক্ত অভিজ্ঞতা সত্বেও জল অপচয় চলছে সমানে। অথচ বছরের অধিকাংশ সময় পানীয় জলের জন্য হাহাকার করতে হয় জেলাবাসীকে। জেলার একাধিক গ্রামে পানীয় জল সরবরাহের পাইপ লাইন পৌঁছালেও জল আসেনি, নির্জলাই থেকে গিয়েছে গ্রামগুলি। ইতিমধ্যেই জলাশয়গুলিও শুকোতে আরম্ভ করেছে। এতে বাড়ির দৈনন্দিন কাজে, গূহপালিত পশু ও গাছের জন্য চরম জল সঙ্কটে পড়তে হবে বলে আশঙ্কা করছেন গ্রামবাসীরা।
অন্যদিকে আন্তরিকতা ও সচেতনতার অভাবে এবং পাইপ লাইনের ত্রুটির কারণে প্রতিদিন নষ্ট হচ্ছে বিপুল পরিমাণ পানীয় জল। বৃষ্টির জল ধরে না রাখায় জলশয়গুলি শুকিয়ে যেতে চলেছে। ফলে আসন্ন শুখা মরশুমে মাটির নিচের জলস্তর নেমে যাবে।ফলস্বরূপ নলকূপগুলি অচল হয়ে পড়ার সম্ভাবনা রয়েছে।এই যুক্তি তুলে ধরে সোমবার থেকে জেলাজুড়ে সচেতনতা প্রচারে নামছে পরিবেশবাদী সংস্থা “মাই ডিয়ার ট্রিজ এন্ড ওয়াইল্ডস”। রবিবার জেলার পরিবেশ সুরক্ষা শিল্পীদের নিয়ে বেলিয়াতোড়ে এক কর্মশালার আয়োজন করেছিল তারা।
এই সংস্থার সভাপতি সঙ্গীতা ধর বিশ্বাস ও সম্পাদক ঝর্ণা গাঙ্গুলি জানান, গত ২০১৯ সালের ২৫ অগাস্ট বাঁকুড়ায় নলবাহিত পরিস্রুত পানীয় জল প্রকল্পে গন্ধেশ্বরী নদী সংলগ্ন কেশিয়াকোলে একটি পাম্প হাউসের উদ্বোধন করতে এসে জলের অপচয় বন্ধ করার জন্য কড়া বার্তা দিয়েছিলেন পুরমন্ত্রী ফিরহাদ হাকিম। এবিষয়ে সচেতনতা বাড়াতে পুরসভাকে প্রচারের পরামর্শও দিয়েছিলেন তিনি। জলের অপচয় বন্ধ করতে সর্বত্রই মিটার লাগানোর চিন্তা ভাবনা করা হচ্ছে। এটা জলের চার্জ নেওয়ার জন্য নয়, জলের অপচয় বন্ধ করার জন্য। এই কথাগুলি পুরমন্ত্রী যখন বলেছিলেন তখন সেই মঞ্চে উপস্থিত ছিলেন তৎকালীন রাজ্যের প্রতিমন্ত্রী শ্যামল সাঁতরা, বিধায়ক শম্পা দরিপা, জ্যোৎস্না মান্ডি, অরূপ খাঁ, আসানসোলের মেয়র জিতেন্দ্র তিওয়ারি, বাঁকুড়া জেলা পরিষদের সভাধিপতি মৃত্যুঞ্জয় মুর্মু, মেন্টর অরূপ চক্রবর্তী, পুরপ্রধান মহাপ্রসাদ সেনগুপ্ত, জেলাশাসক উমাশঙ্কর এস, ও জেলা পুলিশ সুপার কোটেশ্বর রাও প্রমুখ।
পরবর্তীতে গত ডিসেম্বর মাসের শুরুতে নবান্নে জেলাশাসক, মুখ্যসচিব ও বিভিন্ন দপ্তরের মন্ত্রীদের নিয়ে আয়োজিত এক বৈঠকে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় পানীয় জলের অপচয় রুখতে কড়া বার্তা দেন। তিনি বলেন, যেখানে জলের অপচয় হচ্ছে ডিএম, এসপি, বিডিও, পিডব্লিউডি, এগ্রিকালচার, ও সেচ দপ্তরের আধিকারিকরা পুলিশকে সঙ্গে নিয়ে সেই সব জায়গায় সারপ্রাইজ ভিজিট করুন। পানীয় জলের অপব্যবহার করলে সরকার সেটা সহ্য করবেন না। আইন সবার জন্যেই এক।’ জল অপচয় রোধে মুখ্যমন্ত্রীর এই কড়া বার্তা সত্বেও অবস্থার কোনো পরিবর্তন হয়নি।নির্বিকার জনস্বাস্থ্য কারিগরি দফতর, পুরসভা ও পঞ্চায়েতগুলি।
উল্লেখ্য, কোটি কোটি টাকা খরচ করে বাঁকুড়া জেলায় গড়ে তোলা হয়েছে একাধিক জল সরবরাহ প্রকল্প। এই প্রকল্পগুলি থেকেই ব্যাপক পরিমাণে জল অপচয় হয়। এগুলির মধ্যে সব থেকে বড় প্রকল্প হল জলস্বপ্ন প্রকল্প। প্রায় ৪০ কিমি পাইপ লাইন তৈরি করে দুর্গাপুর ব্যারেজ থেকে জল নিয়ে এসে মেজিয়া, গঙ্গাজলঘাঁটি, ইন্দপুর ও তালডাংরা সহ ১৮টি ব্লকে বাড়ি বাড়ি পানীয় জল সরবরাহ করা। গত ২০২০ সালের সেপ্টেম্বর মাস থেকে এই কাজ চলছে। তবে এই জলস্বপ্ন প্রকল্প অনেক গ্রামে স্বপ্নই রয়ে গেছে। এই প্রকল্পের কাজ অনেকাংশে সম্পূর্ণ হলেও বিভিন্ন কারণে বহু গ্রামেই এখনও জল সরবরাহ সম্ভব হয়নি।এমনকি বহু গ্রামে পাইপ লাইন বসানোর পর বাড়ি বাড়ি জলের সংযোগ দেওয়ার কাজও শেষ হয়ে গিয়েছে ২-৩ বছর আগেই।তবে এখনও জল পৌঁছায়নি গ্রামগুলিতে। ফলে চরম জল সঙ্কটের ছবিটা বদলায়নি।
অন্যদিকে এই প্রকল্পে ব্যাপক জল অপচয় হচ্ছে বলে অভিযোগ উঠেছে। বহু জায়গায় পাইপ লাইনের ছিদ্র দিয়ে বিপুল পরিমাণ জল অপচয় হচ্ছে। তাছাড়া দুর্গাপুর ব্যারেজ থেকে বাঁকুড়া পর্যন্ত মেইন পাইপ লাইনে জল সরবরাহ নিয়ন্ত্রনের জন্য বেশ কিছু চাবি রয়েছে। প্রায় প্রতিটি চাবি থেকে সবসময় পড়ে চলেছে বিপুল পরিমাণে জল। এই অবাধে পড়তে থাকা জলের পরিমাণ এতটাই বেশি যে স্হানীয় বাসিন্দারা পলিব্যাগ বা কাপড় দিয়ে আটকে জল ব্যবহার করেন। পাইপ লাইনের যান্ত্রিক ত্রুটি ও নজরদারিকেই এই জল অপচয়ের জন্য দায়ী করছেন গ্রামবাসীরা। তাদের বক্তব্য, এই ভাবে প্রতিদিন যে পরিমাণ জল অপচয় হয় তা দিয়ে জেলার বহু গ্রামের পানীয় জলের চাহিদা মেটানো সম্ভব।
এপ্রসঙ্গে বড়জোড়ার বিধায়ক অলোক মুখার্জির বক্তব্য, এবিষয়ে জনস্বাস্থ্য কারিগরী দফতরের সঙ্গে তাঁর আলোচনা হয়েছে। এই দপ্তরের মতে পাইপ লাইনের ওই অংশগুলি দিয়ে জল বেরিয়ে না পড়লে চাপে পাইপ ফেটে যেতে পারে, তাই সব জেনে শুনেও জল অপচয় বন্ধের চেষ্টা হয়নি।তবে এই যুক্তি মানতে রাজি নয় গ্রামবাসীরা। তাদের মতে এই বিপুল পরিমাণ জল অপচয় রোধে উপযুক্ত প্রযুক্তি ব্যবহার করা দরকার ছিল পিএইচই-র।
বাঁকুড়া পুর এলাকার জল সরবরাহেও একই চিত্র।এখানেও চলছে ব্যাপক জল অপচয়। এই জল অপচয় রোধে গত ২০২৩- এ বাঁকুড়া পুরসভা ও মাই ডিয়ার ট্রিজ এন্ড ওয়াইল্ডস রাস্তার কলগুলি নিয়ে সমীক্ষা করে এবং জল অপচয় রোধে প্রচার চালায়। উল্লেখ্য, বাঁকুড়া পুর এলাকায় পানীয় জলের সঙ্কট মেটাতে ২০১৬ সালে প্রায় ১১৬ কোটি টাকা বরাদ্দে ‘অম্রুত’ (অটল মিশন ফর রিজ্যুভেনেশন অ্যান্ড আরবান ট্রান্সফরমেশন) প্রকল্প নেওয়া হয়। এই প্রকল্পেই গন্ধেশ্বরী নদীর তীরে তৈরি করা হয় প্রায় ২৯ লক্ষ ৫০ হাজার লিটার জলধারণ ক্ষমতার ভূগর্ভস্থ জলাধারটি। এটির উদ্বোধন করতে এসেছিলেন পুরমন্ত্রী।এই প্রকল্পে শহরে তৈরি হয় ৭টি নতুন ওভারহেড ট্যাঙ্ক। শহরজুড়ে পাতা হয় জলের পাইপ। দুর্গাপুর ব্যারেজ থেকেই পাইপ লাইনের মাধ্যমে জল আসে ভূগর্ভস্থ জলাধারে। সেখান থেকে জল যায় পুর এলাকার পুরনো ৬টি ও নতুন ৭টি মোট ১৩টি ওভারহেড ট্যাঙ্কে। সেখান থেকে পানীয় জল সরবরাহ করা হবে শহরে। প্রতিদিন বাঁকুড়া শহরে বিপুল পরিমাণ অপচয় হয়। শহরের রাস্তার ওপরে থাকা অসংখ্য কলের মুখ বন্ধের ব্যবস্থা নেই। অবাধে জল পড়তে থাকে। পৌরসভা নির্বিকার। কম সময়ে বেশি জল পাওয়ার জন্য স্থানীয়রা অনেক জায়গায় কলের মুখ ভেঙ্গে ফেলছেন। এছাড়া স্থানীয় বাসিন্দাদের সর্বক্ষণ জল দেওয়ার জন্য রাস্তার ধারে ছোট ছোট জলাধার তৈরি করা হয়েছে। সরবরাহের সময় সেগুলি উপছে নিয়মিত বিপুল পরিমাণ জল পড়তে থাকে।জলের চাহিদা বিবেচনা করে রাস্তার ধারে কল বসানো হয়। এতে কোনো কোনো কলের মুখ খোলা, যা থেকে জল অবাধে পড়তে থাকে।