আমি তোমায় ভালবাসি

অশোক সেনগুপ্ত, আমাদের ভারত, ৮ জানুয়ারি: ৩০ বছর আগে আমার সাময়িক প্রবাস জীবনের গোড়ায় জার্মানিতে গিয়ে বেশ কানে বেজেছিল মূলত তিনটে শব্দ। ‘বিটে’, ‘এন্টশ্যূলডিগেন জি’ এবং ‘মাখ নিশট’। স্থানীয় কথাগুলোর মানে যথাক্রমে অনুগ্রহ করে, ক্ষমা করবেন এবং ‘ও কিছু না’। মানুষকে আপন করে নিতে তিনটে মোক্ষম শব্দ।

পশ্চিমবঙ্গে ঠিক এরকম কোনও সর্বজনীন শব্দ আছে কি? বাংলাদেশে কিন্তু আসা ইস্তক আতিথেয়তার পরশের পাশাপাশি শুনছি ‘সমস্যা নাই’ কথাটা। এত বহুল ব্যবহৃত শব্দ যে আমাদের দলপতি স্নেহাশিস (সুর) পর্যন্ত নিখুঁত সেই ঘরানায় ‘সমস্যা নাই’ আর মালামালের মত কিছু শব্দ ব্যবহার করতে শুরু করল।

কলকাতায় দ্বিচক্রযানে যাঁরা যাতায়ত করেন, ‘রাপিডো’ বেশ পরিচিত অ্যাপ। ঢাকায় তেমনই ‘ও ভাই‘ বা ‘পাঠাও’ অ্যাপ। সংসদ ভবনে গ্যালারির নাম মেঘনা যমুনা। বিমানবন্দরে ভিআইপি লাউঞ্জে দুটি অপেক্ষাগৃহের নাম ‘শিউলি’ আর ‘কামিনী’। মাছ এদের কাছে নিছক মেছো ব্যাপার নয়, পরিবহণ সংস্থার নাম। পথ নির্দেশিকা, প্রতিষ্ঠানের নামফলক— সব বাংলা হরফে। ‘ঢাকা মেট্রো ঠ ১৩-৪৬ ৫৫’, ‘চট্ট মেট্রো চ ১১-৯৫–১০’ গাড়ির ক্রমিকফলকে এরকম লেখা দেখে তাই অন্তত ভাষাগত দিক থেকে চোখের তৃপ্তি হয়। বিমানবন্দর থেকে চট্টগ্রামমুখী উড়ান উড়ল। ঘোষণা হচ্ছে প্রথমে বাংলায়, পরে ইংরেজিতে।

‘ওমা ফাগুনে তোর আমের বনে ঘ্রাণে পাগল করে’ — এ ধরণের কোনও কলি শুনলে এখনও আমাদের মনে দোলা দেয়। মন উদাস হয়ে যায় জীবনানন্দ দাসের কবিতার লাইনগুলোর কথা মনে পড়লে। দুঃখ লাগে, পরবর্তী প্রজন্মের ছেলেমেয়েদের একটা বড় অংশ বহুশ্রুত এইসবের সঙ্গে পরিচিত নয়। মুছে যাচ্ছে ভাষার সেই আবেগ। এর জন্য আমরা নিজেরা কতটা দায়ী?

ভারতের নয়া শিক্ষানীতিতে ভারতীয় প্রাদেশিক ভাষার উন্নয়নের ওপর গুরুত্ব আরোপের কথা বলা হয়েছে। অনেকে আশঙ্কা করছেন, আসলে কৌশলে একটি বিশেষ ভাষা চাপিয়ে বা প্রসারিত করার চেষ্টা হচ্ছে। এগুলো নিয়ে আগে একাধিক লিখেছি। প্রতি পরতে মনে প্রশ্ন জাগছে, আজ পশ্চিমবঙ্গে মাতৃভাষার কৌলিন্য কতটুকু আমরা রক্ষা করছি? আদৌ তার সদিচ্ছা পশ্চিমবঙ্গের আছে কি? আবার একটা ২১ ফেব্রুয়ারি আসবে। ফেসবুকে পশ্চিমবঙ্গের বাঙালি কুম্ভিরাশ্রু ফেলবে। সারা বছর ব্রাত্য থাকবে ভাষাটা। প্রতিকারের কোনও পথ আছে কি?

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *