অশোক সেনগুপ্ত,
আমাদের ভারত, ১৩ অক্টোবর:
‘দয়াময়ীর কথা’
‘…মা খেদের সঙ্গে উত্তর করেছিল, ‘গাঁয়ের হিন্দুরা সব চইল্যা গেল। হিন্দুদেরই তো জমিজায়গা আছিল, পয়সাকড়ি, শখসাধ আছিল। একজন হিন্দুর জমি পাঁচজন মোসলমানেও কিনতে পারল না। ….. মায়ের বোধ ছিল না, পশ্চিমবঙ্গে মায়ের গর্বের ভাইও উদ্বাস্তু হয়েই আশ্রয় নিয়েছিল।’
‘দয়াময়ীর কথা’-য় লিখেছেন সুনন্দা সিকদার। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ২০০৮ সালের লীলা পুরস্কারপ্রাপ্ত বইটি আসলে ১৯৫১ থেকে ১৯৬১ সালের পুববাংলার এক প্রত্যন্ত গ্রামের শৈশবস্মৃতি- এক বালিকার। ‘গাঙচিল’-এর প্রকাশনা। যাঁরা পড়েননি, সম্ভব হলে পড়ার চেষ্টা করবেন। দেশান্তরী হওয়ার তীব্র যন্ত্রনা কীভাবে যুগ যুগ ধরে ভুক্তভোগীদের কষ্ট দিয়েছে, তার আলেখ্য।
এত বিপুল সংখ্যক মানুষকে চলে আসতে হল, তার জন্য দায়ী কে? এই প্রসঙ্গে জানাই, রাজেন তরফদারের ‘পালঙ্ক’ থেকে শুরু করে বিভিন্ন ছবিতে এসেছে ওপার বাংলা থেকে নাড়ি ছেঁড়ার ব্যথা নিয়ে এপার বাংলায় আসার কথা। অনেকে প্রামান্য নানা বই লিখেছেন। যেমন তথাগত রায়ের ‘মাই পিপল আপরুটেড, দি এক্সোডাস অফ হিন্দুস ফ্রম ইস্ট পাকিস্তান অ্যান্ড বাংলাদেশ’ এবং তাঁর অসাধারণ বই ‘যা ছিল আমার দেশ’।
যোগেশ দত্ত লিখেছিলেন, “যে বছর দক্ষিণের নারকেল গাছটা পড়ে গেল, ওই বছরই তুই জন্মেছিলি,” মা বলেছিল। পরে বড় হয়ে জেনেছি, সালটা ছিল ১৯৩৩। এই ৮৫ বছরে এসে পূর্ববঙ্গের ছোটবেলাটা মনে পড়ে। হ্যাঁ, বাংলাদেশকে এখনও আমি পূর্ববঙ্গই বলি। তা-ই তো বলেছি বরাবরই। সেই পূর্ববঙ্গ অবশ্য একেবারে পালটে গিয়েছে এখন। আমাদের বাড়ির সামনেটায় ছোট্ট একটা নদী ছিল। সেটা যেমন নেই আর এখন।” ২০১৮-র ২২ এপ্রিল আনন্দবাজার পত্রিকায় বড় করে প্রকাশিত হয়েছিল তাঁর এই স্মৃতিকথা। শিরোনাম ছিল ‘তুলসীমঞ্চে প্রদীপ জ্বালিয়ে দেশ ছাড়লেন মা’।
কী অসম্ভব মধুর স্মৃতি, তেমনই টানটান ভাষা— “এই সময়েই শুরু হল মন্বন্তর। গ্রাম থেকে সমস্ত চাল রাতের অন্ধকারে নৌকো বোঝাই করে রাতারাতি উধাও হয়ে যেতে শুরু করল। বাড়িতে নিত্য হা-ঘরে, নিরন্ন লোকেদের আনাগোনা, ‘‘একটু ফ্যান দাও মা।’’ পরে বুঝেছি, এই মন্বন্তর কৃত্রিম। সৈন্যদের জন্য চাল সংগ্রহ করতে গিয়ে ব্রিটিশ সরকার আমাদেরও ভাতে মারার ব্যবস্থা করেছিল। চারদিক জুড়ে তখন স্বদেশি গান চলছে। ব্রতচারী আন্দোলন চলছে। তার মধ্যেই এক দিন গান গাইতে গাইতে পুকুরের কচুরিপানা সাফ করছি আমরা ছোটরা। গানটা ছিল, ‘আয় কচুরি নাশি/এই রাক্ষুসি যে বাংলা দেশে দিচ্ছে গলায় ফাঁসি।’’
“গ্রামে ইতিমধ্যে তলে তলে অনেক কিছু ঘটতে শুরু করেছে। কিছু গোঁড়া ব্রাহ্মণ মুসলিমদের ঘরে ঢুকতে দিত না। শুনতে পাচ্ছিলাম, আনসার বাহিনী নামে পাল্টা এক দল গঠিত হয়েছে। তারা বলতে লাগল, নমাজ পড়ার সময় স্কুল বন্ধ রাখতে হবে। শুনলাম, দেশ ভাগ হয়ে যাচ্ছে। এ দিকটা পূর্ব পাকিস্তান, আর লাহৌর, করাচির দিকে পশ্চিম পাকিস্তান। বাবা নীরব, গ্রামের সকলে কানে কানে চুপিসারে কী আলোচনা করে, বুঝতেও পারি না।
সেই রাত্তিরটা বুঝতে অবশ্য অসুবিধা হয়নি। মা নির্বাক, খালি দু’চোখ বেয়ে জল। বাড়িতে কাজ করত দেবুদা, তাকে ডেকে বাবা বললেন, ‘‘আজ থেকে এই ঘরে থাকবি।’’ কাঁদতে কাঁদতে মা তুলসীমঞ্চে একটা প্রদীপ জ্বালিয়ে দেবুদাকে বললেন, ‘‘যত দিন পারিস, প্রদীপটা জ্বালিয়ে রাখিস। দেশ ভাগ হয়ে গিয়েছে।’’
দেশত্যাগ, দেশ ভাগের এই সব কথা আজ ক‘জনের বুকের মধ্যে কতটা মোচর দেয়? স্মৃতিচারণেই বা কী লাভ? ‘দি কাশ্মীর ফাইলস’-এর কারণে অনেকের মনে হয়ত নতুন করে জেগে উঠেছিল চিরকালীন প্রশ্নটা। আবার সব চুপ।
ছবিতে সৈকত হোসেনের আঁকা কাগজে জল রঙ।
কোকিল পেয়ারি জমিদার বাড়ি, ঢাকা।
*Save the heritages of Bangladesh* FB group
*****