পূর্ববঙ্গে ভিটেছাড়া— কিছু ভাবনা (৩)

অশোক সেনগুপ্ত
আমাদের ভারত, ১২ অক্টোবর: পূর্ববঙ্গে হিন্দুরা দীর্ঘদিন ধরে ছিল শিক্ষিত, সম্পন্ন সম্প্রদায়। কিন্তু কত হিন্দু চলে এসেছেন এপার বাংলায়? কেউ বলেন দেড় কোটি, কেউ বলেন দু’কোটি। কিন্তু কেন চলে এলেন সাত পুরুষের ভিটে ছেড়ে? প্রশ্নটা তুললেই প্রশ্নকর্তাকে দাগিয়ে দেওয়ার চেষ্টা হয় সাম্প্রদায়িক অ্যখ্যায়। দেশ ছেড়ে চলে আসার সেই অভিজ্ঞতার কথা জানানোর মত আজ খুব বেশি লোক বেঁচে নেই। যাঁরা আছেন বয়সের ভাড়ে জীর্ণ, অসুস্থ। তাহলে এই বিরাট অধ্যায়টা নিয়ে আর গবেষণা হবে না? ভবিষ্যৎ প্রজন্মের ছেলেমেয়েদের কাছে চাপা পড়ে যাবে সেসব কথা?

সামাজিক মাধ্যমে ‘সেভ দি হেরিটেজ অফ বাংলাদেশ’ গ্রুপ প্রায়শই পরিত্যক্ত বাড়িগুলোর ছবি দেন। দেখার মত স্থাপত্য। এখন ওদেশে এগুলো দেখার চাহিদা বাড়ছে। নিয়মিত আগাম ঘোষণা করে ‘হেরিটেজ ওয়াক’ হচ্ছে। রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে বাড়িগুলোর অবস্থা জীর্ণ থেকে জীর্ণতর হচ্ছে। ক’বছর আগে ভাওয়ালের রাজবাড়ি দেখতে গিয়েছিলাম। কত বড় জমির ওপর কতগুলো বাড়ি! অনেকটা সরকার নিয়ে কিছু দফতর বসিয়েছে। অনেকটা দখল হয়ে আছে। তাদের মধ্যে স্থানীয় ক্লাবও আছে।

‘দেশ কি শুধুই স্বপ্ন আর স্মৃতি’? এই প্রশ্ন উস্কে দিয়ে অধীর বিশ্বাস তাঁর ‘উদ্বাস্তু পঞ্জিকা’-র মুখবন্ধে ২০১৪-র ২০ মার্চ লিখেছেন, “দেশ ছাড়ার আগের দিন পর্যন্ত হারিকেন হাতে আমি বাবার আঙুল পেঁচিয়ে ধরে থাকতাম। ভুতুম পাখি বা শেয়ালের ডাক শুনতে শুনতে রাস্তা পার হতাম। এ দেশে এসে মনে হত ধান-রাখা জালার মধ্যে বসে আছি। মাথার উপর বনবন করে ঘুরছে সব কিছু— আমার গ্রাম, আমার স্কুল, মাঠ-ময়দান। বাবা-মা, পাঁচু-কাকা বা পদাবলি কীর্তন। আমার শৈশবের আগে মৃত বোন। যখন বাসস্থান ছিল পূর্ব পাকিস্তানের জেলা যশোর, তখন স্বপ্নে ছিল দেশ ইণ্ডিয়া, এখন বাসস্থান শহর কলকাতা হলেও কেউ যখন ‘দেশ কোথায়’ জিজ্ঞেস করে, বলে উঠি, জেলা যশোর, গ্রাম মাগুরা। আমার ছেলেরা অবাক হয়। ওদের অবাক হওয়ায় অপ্রস্তুত আমি গ্রামের সেই নবগঙ্গায় ডুব-সাঁতারে চোর চোর খেলতে খেলতে হঠাৎ করেই জেগে উঠি। অবাক হয়ে চোখ কচলাই। আমার দেশ তা হলে কোথায়? দেশ কি শুধুই স্বপ্ন আর স্মৃতি?“

বিমান বসু তাঁর স্মৃতিকথায় জানিয়েছেন, “এই পৃথিবীর আলো দেখার সময়েই মাকে খুব কষ্ট দিয়েছিলাম। আমি যখন গর্ভে, পূর্ববঙ্গ থেকে মাকে নিয়ে বাবা স্টিমারে গোয়ালন্দ হয়ে ট্রেনে কলকাতা এসেছিলেন। শুনেছি, স্টিমারযাত্রায় মায়ের রক্তক্ষরণ হয়েছিল। ট্রেনে উঠে রক্ত বন্ধ হয়। কলকাতায় এসে তখনকার ক্যাম্পবেল হাসপাতালের নামী ডাক্তার নীলরতন সরকারের (এখন হাসপাতালটা তাঁরই নামে) কাছে বাবা লিখে পাঠিয়েছিলেন মাকে পরীক্ষা করাতে। প্রসবের সময় আর পাঁচটা শিশুর মতো আমার মাথা আগে বেরোয়নি, বেরিয়েছিল পা। তাতে প্রচুর রক্তপাত হয়ে মা কষ্ট পেয়েছিলেন খুব। ডাক্তার বলেছিলেন, স্টিমারযাত্রার সময়ে ‘হাইড্রলিক ইমপ্যাক্ট’-এ গর্ভস্থ শিশুর অবস্থান পরিবর্তন হয়েছিল। আমি বড় হয়ে পরিচিত ডাক্তারদের জিজ্ঞেস করেছি, এ রকম আবার হয় না কি! ওঁরা বলেছেন, হতে পারে।

মা না থাকলে রাজনীতি করা, কমিউনিস্ট পার্টি করতে আসা সম্ভব হত না। এই বয়সে ছোটবেলায় ফিরে যেতে ইচ্ছে হলে আমার মা হেমবরণী বসুর কথাই তাই মনে পড়ে খুব।” …

কিন্তু কেন, কাদের জন্য প্রাণ হাতে করে, রাতের অন্ধকারে, পূর্বপুরুষদের ভিটে ছেড়ে একবস্ত্রে হেমবরণী বসু এবং তাঁর মত লক্ষ লক্ষ মহিলাকে চরম অনিশ্চয়তায় দেশান্তরী হতে হয়েছিল, কখনও সেগুলো নিয়ে কি যথেষ্ঠ চর্চা হয়েছে? যাঁরা সেগুলো নিয়ে চর্চা করতে চেয়েছেন, কেন তাঁরা আমাদের চারপাশের অনেকের চোখের বালি হয়েছিলেন? এর উত্তরগুলো কীভাবে পাব?

ছবিতে ’হরিচরণ জমিদারবাড়ি শ্যামনগর’।
ঋণ— জিল্লুর রহমান।
*Save the heritages of Bangladesh* FB group
*****

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *