পূর্ববঙ্গের হিন্দু স্মৃতি বিশেষ সাক্ষাৎকার- ১ টিউবের পেস্টের মত টিপে টিপে বার করে দেওয়া হয়েছে হিন্দুদের: তথাগত রায়

আমাদের ভারত, ১৫ এপ্রিল: তথাগত রায়— প্রতিযোগিতামূলক সর্বভারতীয় পরীক্ষায় (ইণ্ডিয়ান ইঞ্জিনিয়ারিং সার্ভিস) উল্লেখযোগ্য কৃতিত্বের পরিচয় রেখেছেন। প্রাক্তন রাজ্যপাল, ভারতীয় জনতা পার্টির প্রাক্তন রাজ্য সভাপতি।

প্রশ্ন ১ — আপনার সঙ্গে পূর্ববঙ্গের সম্পর্কটা ঠিক কীরকম?

উত্তর— পূর্ববঙ্গের ব্রাহ্মণবেড়িয়ার এক ছোট জমিদার তারামিয়া সাহেবের নায়েব ছিলেন আমার ঠাকুর্দা গিরীশ চন্দ্র রায়। সে প্রায় ১০০ বছর আগের কথা। বাবার জন্ম ওখানেই। বাবা ব্রাহ্মণবেড়িয়া থেকে প্রথমে অসম, তারপর মণিপুর হয়ে কলকাতায় আসেন এমএসসি পড়তে। এটা গত শতকের তিনের দশকের কথা। ঠাকুরদা প্রয়াত হন ১৯৩৭-এ। বাবা কাজ করতেন কলকাতায় সার্ভে অফ ইণ্ডিয়ায়। আমার জন্ম এ শহরেই। কিন্তু পূর্বপুরুষদের দৌলতে ওই তল্লাটের সঙ্গে একটা মানসিক যোগসূত্র রয়েছে।

অশ্বিনী দত্ত রোডে একটা ভাড়া বাড়িতে থাকতাম আমরা। প্রমথনাথ বিশীর সঙ্গে বাবার ভীষণ অন্তরঙ্গতা ছিল। দু’জনেরই শিকড় পূর্ববঙ্গে। কলকাতায় আমাদের বাড়িতে একটা ঘর রাখা ছিল। পূর্ববঙ্গ থেকে আসা পরিচিত অতিথিরা ওই ঘরে কিছুদিন করে থাকতেন। সেই হিসাবে একটা গভীর মানসিক যোগাযোগ ছিলই।

প্রশ্ন— পূর্ববঙ্গের হিন্দু নিধনের ব্যাপারটা কোন সময়ে, কীভাবে আপনার মনে দাগ কেটেছিল?

উত্তর— দেশ স্বাধীন হল। পূর্ববঙ্গ হল পূর্ব পাকিস্তান। ১৯৫৩ সাল নাগাদ আমার দেখা একটা দৃশ্য আচমকা যেন আমাকে মানসিকভাবে সাবালক করে দিল। আমার বয়স তখন বছর আট হবে। বাবা ও প্রমথনাথ বিশীর সঙ্গে শান্তিনিকেতন যাচ্ছিলাম। দেখলাম কাতারে কাতারে লোক। পশুর মত বাস করছে। ওরা কারা, প্রশ্ন করায় বাবা বললেন, “ওরা রিফিউজি“। বালকসুলভ চপলতায় কোথা থেকে এসেছে, কেন এসেছে— একের পর এক প্রশ্ন করলাম। বাবা উত্তর দিলেন। আমার নিস্পাপ মনে প্রশ্ন উঠল, আমরা কেন এখানকার মুসলমানদের তাড়িয়ে দিচ্ছি না? তাহলে তো হিন্দুদের জায়গা হতে পারে। বাবাকে সেই প্রশ্ন করতেই তাঁর চটজলদি জবাব, “চুপ কর। এক চড় মারব।“ আমি চুপ করে গেলাম। কিন্তু তার পর সাত দশকে এর উত্তর খুঁজে পাইনি।

এর পরেও নানা সময় এই অনুভবের অবকাশ আমার হয়েছে। ১৯৬৪ সালে তৎকালীন শিবপুর বিই কলেজে চতুর্থ বর্ষে পড়ার সময় পূর্ব পাকিস্তানের কিছু হিন্দু ছাত্র ভর্তি হল। ওরা পূর্ব পাকিস্তানে হিন্দু নির্যাতনের প্রত্যক্ষদর্শী। মুসলমানদের অত্যাচারে পালিয়ে এসেছিল। ওদের সঙ্গে কথাবার্তার পর উপলব্ধি হল, ভারতীয় ধর্মনিরপেক্ষতার মধ্যে একটা খুব বড় ফাঁকি আছে।

প্রশ্ন— কেন সাবেক পূর্ববঙ্গ এবং পূর্ব পাকিস্তানে হিন্দু জনসংখ্যা এভাবে কমে গেল?

উত্তর— গভীরভাবে তা জানার, অনুভব করার চেষ্টা করেছি। এর প্রথম অংশটা পাকিস্তান আমলে। পাক সরকারের ঘোষিত দমননীতিতেই ছিল ওদেশ থেকে হিন্দুদের তাড়িয়ে দেওয়া হবে। হিন্দুদের বড় বড় বাড়ির ওপর বেশি কর ধার্য এবং নানাভাবে বাড়িগুলো হুকুমদখল করার চেষ্টা হত। তসলিমা নাসরিন ‘ফেরা’-তে এর উল্লেখ করেছেন। এর পর চেষ্টা হয় আরবি হরফে বাংলা লেখা চালুর। সেই চেষ্টা ব্যর্থ হল।

পূর্ব পাকিস্তানের মুখ্যসচিব ছিলেন আইসিএস আজিজ আহমেদ। বিকে নেহরু তাঁকে ‘নটোরিয়াসলি অ্যান্টি হিন্দু’ বলে চিহ্ণিত করেছিলেন। সেই আজিজ আহমেদ ১৯৫০-এর জানুয়ারি মাসে খুলনার কালশিরা গ্রামে একটি হিন্দু পরিবারের ওপর আক্রমণ হানলেন। পাল্টা মারও আসল। এর পর নানাভাবে বাড়তে লাগল হিন্দু নির্যাতনের মাত্রা। কিন্তু পশ্চিমবঙ্গের পত্রপত্রিকাগুলো সযত্নে সেই খবর গোপন করতে লাগল।

পরিস্থিতি জটিল হচ্ছে দলে দলে ছিন্নমূল উদ্বাস্তু আসতে শুরু করল এই বাংলায়। তা দেখে পশ্চিমবঙ্গের তৎকালীন মুখ্যসচিব সুকুমার সেন ঢাকায় গেলেন। তিনিও ছিলেন আইসিএস। আজিজ তাঁকে মুখে সমাদর করলেন। কিন্তু ওইটুকুই। পঞ্চাশের দাঙ্গায় পূর্ব পাকিস্তানে দু’মাসে অন্তত ৫০ হাজার হিন্দু খুন হলেন। ১৯৫০-এর ১২ ফেব্রুয়ারি মেঘনার ওপর অ্যান্ডারসন সেতুতে ট্রেন থামিয়ে হিন্দু যাত্রীদের গলা কেটে নির্বিচারে নদীতে ফেলে দেওয়া হয়েছিল। তার অন্যতম সাক্ষী রঞ্জিৎ কর এখনও জীবিত। তবে অসুস্থ। বয়স ৯২।

ওই পরিস্থিতিতে দু’দেশের প্রধানমন্ত্রীর ভূমিকা কী ছিল?

উত্তর— জওহরলাল নেহরুর চাপে সব পত্রপত্রিকা পাকিস্তানে ওই দাঙ্গার খবর চেপে গেল। তবু এই বঙ্গে তার প্রতিক্রিয়া হল। পাকিস্তানের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী লিয়াকৎ আলির সঙ্গে নেহরু কিছু এলাকা যৌথ পরিদর্শন করতে চাইলেন। লিয়াকৎ রাজি হলেন না। বরিশালে হিন্দু নিধনের মাত্রা দেখে ব্যাকুল হলেন পাক মন্ত্রী যোগেন মণ্ডল। তিনি লিয়াকৎ আলিকে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের কথা বললেন। লিয়াকৎ বললেন, সব বাজে কথা। এরকম বললে জেলে ভরে দেব। ভীতসন্ত্রস্ত যোগেন মণ্ডল লুকিয়ে কলকাতায় চলে এসে এখান থেকে পদত্যাগপত্র পাঠালেন পাক প্রধানমন্ত্রীকে।

১৯৪৭-এর পর পঞ্জাবে ধর্মের ভিত্তিতে জনবিনিময় হয়েছিল। তখন গান্ধী, প্যাটেলের একটা বড় প্রভাব ছিল। কিন্তু ’৫০-এ তাঁরা নেই। শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জি পঞ্জাবের মত এখানেও ধর্মের ভিত্তিতে জনবিনিময়ের দাবি তুললেন। নেহরু রাজি হলেন না। যদিও চাপে পড়ে ১৯৫০-এর ফেব্রুয়ারি ও মার্চ মাসে পশ্চিমবঙ্গে এলেন। রানাঘাটে উদ্বাস্তুশিবিরে এক হিন্দু বধূর কানে দুল দেখে সিদ্ধান্তে এলেন, এরা খুব সুখে আছে। সেটা সোনার না ইমিটেশনের ছিল, কে তার খবর রাখেন?

১৯৫০-এর ৮ এপ্রিল লিয়াকৎ এলেন দিল্লিতে। দাঙ্গা থামানোর লক্ষ্যে নেহরুর সঙ্গে চুক্তি করলেন। ১৯৪৮-এই এরকম দু’দফা চুক্তি হয়েছিল। তাতে কোনও কাজের কাজ হয়নি। এবারেও এটা যে নিছকই একটা লোকদেখানো ব্যাপার, হিন্দুরা সুরক্ষা পাচ্ছে না, তা বুঝে মন্ত্রিসভা থেকে পদত্যাগ করে নতুন দল তৈরি করলেন শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জি। ১৯৫১-তে বগুড়ার শান্তাহার স্টেশনে অজস্র হিন্দু খুন হলেন।

প্রশ্ন— মুক্তিযুদ্ধের সময়কালে পূর্বপাকিস্তানে হিন্দুদের অবস্থা কীরকম ছিল?

উত্তর— প্রচুর হিন্দু খুন হয়েছে ওই সময়কালে। পাক সেনা, রাজাকাররা মিলে ওই খুন করেছিল। ১৯৭১-এ খুলনার চুকনগরে যে গণহত্যা হয়েছিল তা জালিয়ানওয়ালাবাগের হত্যাকাণ্ডের চেয়েও ১০ গুন বড়। এক দিনে ১০ হাজার হিন্দু সেখানে খুন হন। ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী এবং সেনাধ্যক্ষ মানেকশরের কথা হয়েছিল। ঠিক হয়, মে মাসে জলে ভাসবে পূর্ব পাকিস্তান। তার পর নভেম্বরে ভারত যুদ্ধে লিপ্ত হবে।

প্রশ্ন— কিন্তু বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পরেও কি ওপার থেকে এপারে আসার ঢল অব্যাহত রয়ে গেছে?

উত্তর— হ্যাঁ। শেখ মুজিব যতদিন বেঁচে ছিলেন, তাজউদ্দিনের সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক ভাল ছিল, হিন্দুরা ওদেশে মোটামুটি ভাল ছিল। তসলিমা নাসরিন ‘লজ্জা’-তে এ কথা লিখেছেন। কিন্তু হিন্দুরা ওদেশে ভয়ে আছে। নিরাপত্তা বোধটা নেই। যে কোনও সময় বিপদের আশঙ্কা করে তারা।

প্রশ্ন— কিন্তু বিএনপি-র চেয়ে আওয়ামি লিগ বাংলাদেশের হিন্দুদের কাছে কি বেশি আদরনীয় নয়?

উত্তর— অবশ্যই! বিএনপি-র আমলে (২০০১- ২০০৭) কত হাজার হিন্দু বাংলাদেশে খুন হয়েছেন, তার হিসেব কে রাখেন? সেই তুলনায় আওয়ামি লিগের আমলে সংখ্যাটা অনেক অনেক কম। শাহরিয়ার কবীরের শ্বেতপত্র— বাংলাদেশে সংখ্যালঘু নির্যাতনের ১৫০০ দিন পড়লে তা বোঝা যায়।

প্রশ্ন— বিজেপি সরকার কেন্দ্রে আসার পরেও কেন বাংলাদেশের হিন্দুরা যথেষ্ঠ মনোবল পেলেন না?

উত্তর— পশ্চিমবঙ্গের বাসিন্দারাই কি ওপার বাংলার হিন্দুদের মনে জোর আনতে সমবেত কিছু করতে পেরেছেন? এপার বাংলার বাঙালিদের একটা বড় অংশ গান্ধীবাদ আর মার্কসবাদে নিমজ্জিত। ওপারের হিন্দু নির্যাতন তাঁদের কাছে গৌন। তাঁরা এ বিষয়ে কিছু বলা পাপ বলে মনে করেন। এই যদি প্রকৃত ছবি হয়, দিল্লির অবাঙালি মন্ত্রী-আমলাদের ওপর দায় কিভাবে চাপাতে পারি আমরা?

প্রশ্ন— কোন সময়কালে ওপার থেকে এপারে বেশি লোক এসেছেন?
উত্তর— এটার জন্য আমি আমার বইয়ে (‘যা ছিল আমার দেশ’) ব্যবহৃত কয়েকটি তালিকা পেশ করছি। এতে পাঠক অনেকটাই অনুমান করতে পারবেন।

প্রশ্ন— কেন পূর্ব পাকিস্তান এবং পূর্ববঙ্গে হিন্দু নির্যাতন নিয়ে অনেকে মুখ বন্ধ করে রাখেন?

উত্তর— পরবর্তীতে পাকিস্তানের করাচীতে ভারতীয় কনসাল জেনারেল নিযুক্ত হয়েছিলেন মণিশঙ্কর আইয়ার। ‘Pakistan Papers’ শিরোনামে তিনি একটি ছোট বই প্রকাশ করেন। সদ্য স্বাধীন হওয়া বাংলাদেশ এবং সেখানে পাকিস্তানী কুকীর্তি নিজের চোখে দেখা এবং করাচী থাকার সুবাদে এইসব ব্যাপারে পাকিস্তানী চক্রান্ত তাঁর জানা থাকার কথা। এই পরিপ্রেক্ষিতে আশা করা গিয়েছিল যে তাঁর বইতে পূর্ব পাকিস্তানে সেনাবাহিনীর অত্যাচার সম্পর্কে কিছু উল্লেখ থাকবে। আশ্চর্যের বিষয়, একটি কথাও নেই।

এই লেখকের ঘনিষ্ঠ বন্ধু (বর্তমানে প্রয়াত) শ্যামল দত্ত চৌধুরী পূর্ববঙ্গাগত পরিবারের ছেলে এবং একজন সংবেদনশীল মানুষ বলে সুপরিচিত, সাহিত্যচর্চাও করেন। লেখক এ ব্যাপারে বই লিখছে শুনে বলেছিলেন, “কি দরকার এসব লেখার। একটা ঘা শুকোচ্ছিল। শুকোতে দেওয়াই তো উচিত।”

খুব উদার দৃষ্টিতে দেখতে গেলে বলতে হয় এঁরা সত্যিই বিশ্বাস করেন যে মানবজাতির কল্যাণের জন্য, হিন্দু ও মুসলিমের মধ্যে ভবিষ্যৎ সম্পর্কের জন্য এই ইতিহাস লুকিয়ে রাখা উচিত, নিশ্চিহ্ন করে দেওয়া উচিত। এ সম্বন্ধে একটি কথাও বলা বা লেখা উচিত নয়। কালক্রমে এসব ঘটনা যা দেখেছিলেন তারা সবাই মারা যাবেন এবং কেউ এসব নিয়ে উচ্চবাচ্য করলে ‘শোনা করা’ বলে সেটা উড়িয়ে দেওয়া যাবে। ফলে চিরস্থায়ী শান্তি বিরাজ করবে।

যদি এদের বলা হয় যে সত্যকে চেপে রাখা কখনোই উচিত নয়, ইতিহাস নিশ্চিত করে নেওয়ার পক্ষে কোনো যুক্তিই থাকতে পারে না, তখন তাঁরা কি বলবেন। আন্দাজ করা যেতে পারে যে তাঁরা নিম্নলিখিত যুক্তির (যদি একে যুক্তি বলা যায়) এক বা একাধিক হাজির করবেন।

যুক্তি ১। আহা, যাক না এসব প্রাচীন ইতিহাস (Forgive and Forget, Let Bygones. by Bygones), কি হবে এসব পুরানা কাসুন্দি ঘেঁটে?

যুক্তি ২। একটা অন্যায়ের প্রতিকারে কি আর একটা অন্যায়?

যুক্তি ৩। এটা বিনা কারণে হয়নি। হিন্দুদের কাজে মুসলিমদের প্রচুর অপমান, অত্যাচার সইতে হয়েছিল।

যুক্তি ৪। এসব নিয়ে বললে বা লিখলে দাঙ্গা লেগে যেতে পারে।

যুক্তি ৫। দু’তরফেই প্রচুর খুনোখুনি হয়েছে।

যুক্তি ৬। প্রচুর মুসলমান আছেন যারা হিন্দুদের প্রাণ বাঁচিয়েছেন।

যুক্তি ৭। এগুলো সব ব্রিটিশদের দোষ- Divide and Rule Policy এসব মুসলমানদের দিয়ে করানো হয়েছে।

যুক্তি ৮। ওদের ধরনই এইরকম কী আর করা যাবে?

যুক্তি ৯। হিন্দুদের উপর আলাদা করে নির্যাতন হয়নি, আওয়ামী লীগ সমর্থকদের অত্যাচার হয়েছে। (বিশেষ করে ২০০১ পরবর্তী নির্যাতনের প্রতি প্রযোজ্য)।

যুক্তি ১০। নির্যাতনের কারণ মূলতঃ অর্থনৈতিক, ধর্ম কেবল মোড়ক।

যুক্তি ১১। এসব কিছুই হয় নি। সব বাজে কথা। অন্তত বাড়িয়ে বলা হয়েছে। হিন্দুরা ভয়ে পালিয়েছে। আগে মুসলমানদের ওপর অত্যাচার করেছিল। তার প্রতিশোধের ভয়ে।

যুক্তি ১২। আর তো হিন্দুরা পারে না, সেইজন্য চলে গেছে।

প্রশ্ন— এই যুক্তিগুলোর জবাব কীভাবে দেবেন?

উত্তর— প্রথম যুক্তি/ আগেই আলোচনা হয়েছে তাই পুনরায় আলোচনার দরকার নেই। সংক্ষেপে এই যদি যুক্তি নামতে হয় তাহলে ইস্কুল-কলেজের পাঠ্যসূচী থেকে ইতিহাস বিষয়টা তুলে নিতে হয়। শুধু একটা লাইন লিখলেই হবে, “সৃষ্টির আদিকাল থেকে মানবজাতি সর্বদাই পরস্পরের সঙ্গে গলাগলি ভাবে বসবাস করেছে। কখনও যুদ্ধবিগ্রহ করেনি।“

দ্বিতীয় যুক্তি—এই ‘যুক্তিবাজরা ধরে নেন যে প্রথমেই বলা হচ্ছে যেভাবে পূর্ব থেকে হিন্দুদের তাড়ানো হয়েছে তেমনিভাবে পশ্চিমবঙ্গ থেকে মুসলমানদের তাড়ানো উচিত। আজ এটা ভাবাই যায় না। ১৯৪৭ সালে যেত। কারণ পাঞ্জাবে এই-ই হয়েছিল। লোক বিনিময় ভারতের পঞ্জাবে একটি মুসলমানও পড়ে থাকেনি, পাকিস্তানী পঞ্জাবেও হিন্দু-শিখ পড়ে থাকেনি। ভারতে মালেরকোটলা এবং পাকিস্তানে নানকানা সাহিব-এ সামান্য কয়েকজন ব্যতিক্রম ছিলেন। তাঁরা ধর্তব্যের মধ্যেই নয়। কিন্তু আজকের ঘড়ির কাঁটা পিছনে ঘোরানো যাবে না। পাকিস্তান প্রায় সমস্ত হিন্দু-শিখকে তাড়িয়ে ছেড়েছে এই যুক্তিতেও না। ভারতে মুসলমানরা সম্মানিত নাগরিক হিসেবে আছেন, থাকবেন তাঁদের স্পেশাল তোয়াজ করা হবে কি না সেটা অন্য প্রশ্ন।

এই যুক্তির একটি রকমফের আছে চোখের বদলে চোখ নীতি মানতে গেলে সারা পৃথিবী অন্ধ হয়ে যাবে। এটি একটি এমন যুক্তি যাঁরা দেন জেনেশুনেই দেন। অতএব মূঢ় নয় ভণ্ডও বটে। তার সবচেয়ে বড় উদাহরণ, পৃথিবীর সব দেশ তাহলে এত কোটি কোটি ডলার খরচ করে সেনাবাহিনী পোষে কেন?
জিজ্ঞাসা করলে জবাব পাবেন,

আমরা আক্রমণ করব না, কিন্তু কেউ আমাদের আক্রমণ করলে অবশ্যই প্রত্যাঘাৎ করব, যাকে ইংরাজিতে বলে সেকেণ্ড টাইপ কেপেবিলিটি। এটাই জগতের নীতি। ব্যাতিক্রমবিহীনভাবে পৃথিবীর সমস্ত দেশ বোকা, চালাক কেবল এই অন্ধত্বের যুক্তিদাতারা।

উদাহরণ হিসাবে বলা যায়, ১৯৬২ সালে চীন ভারত আক্রমণ করে। ভারত যখন অপ্রস্থত অবস্থায় খাবি খাচ্ছিল তখন আচার্য বিনোবা ভাবে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে এসে বলেছিলেন, সীমান্তে সেনা পাঠানোর কোনো সরকার নেই। তার বদলে বাচ্চা ছেলে পাঠাব, তারা গিয়ে চীনাদের বলবে, আপনারা কেন এখানে এসেছেন, ফিরে চলে যান। সঙ্গে এও বলেছিলেন যে মা কালীকে পুজো করা হিংসার জন্ম দেয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা বলেছিল, “আপ চীন চলা যাইয়ে। মা কালী কি জয়!“

One thought on “পূর্ববঙ্গের হিন্দু স্মৃতি বিশেষ সাক্ষাৎকার- ১ টিউবের পেস্টের মত টিপে টিপে বার করে দেওয়া হয়েছে হিন্দুদের: তথাগত রায়

  1. Alok Sarkar says:

    পূর্ব পাকিস্তান বা অধুনা বাংলাদেশে হিন্দু নিধন সম্পর্কে আমার সংক্ষিপ্ত বক্তব্য নিম্নরূপ:
    যে নিজের মনকে সংযত রাখতে পারে সে সব সময় শত অশান্তির মধ্যেও ভালো থাকে এবং অপরকেও ভালো রাখতে পারে। এর কারণ হচ্ছে মনের সাহায্যে আমাদের জগত তৈরি হয়। অশান্ত মন, লোভী মন, জেদী মন, অজ্ঞানী মন কখনো আমাদের শান্তি দিতে পারেনা। দেহ দিয়ে আমরা সুখ ভোগ করি, মন দিয়ে শান্তি উপভোগ করি; সুতরাং দেহ সুখের চেয়ে মনের শান্তি অনেক বেশি জরুরি। দুঃখের বিষয় এই সাধারণ কথাটা বেশির ভাগ নেতা মন্ত্রীরা জানেন না এবং কেউ যদি তাদের কথাগুলো বোঝাবার চেষ্টা করেন তারা বুঝতে চান না। এর কারণ কি? কারণ আর কিছুই নয়, শত শত বছরের অশিক্ষা, কুশিক্ষা। মানুষ নিজের প্রকৃত স্বরূপকে উপলদ্ধি করতে পারছে না বলেই এত অশান্তি। মানুষ শরীর নয়, প্রাণ নয়, মন নয়, বুদ্ধি নয়, অহংকার নয়, মানুষ হচ্ছে নিত্য শুদ্ধ বুদ্ধ মুক্ত অনন্ত আনন্দময় সত্তা বা আত্মা। আত্মা বলতে আমরা কি বুঝব? আত্মার অস্তিত্ব কি ভাবে প্রমাণ করব? উত্তরটা বুঝতে পারলে খুব সোজা, না বুঝতে চাইলে খুব কঠিন, প্রায় অসম্ভব! কুরুক্ষেত্রের ধর্মযুদ্ধে শ্রীকৃষ্ণ অর্জুনকে আত্মা সম্বন্ধে খুব স্পষ্ট করে বলেছেন। মানুষ হয় গীতা পড়ে না, অথবা পড়েও ভন্ডামী করে। আত্মা সবকিছুর সাক্ষী স্বরূপ। আমি এখন যে কথাগুলো লিখছি, আমি কি সেগুলো না বুঝে লিখছি, উপলব্ধি করতে পারছি না? আমি প্রত্যেকটি কথা বুঝতে পারছি, যিনি বুঝতে পারছেন, তিনি আমার আত্মা, আমার প্রকৃত সত্তা। আমি বলতে বেশির ভাগ মানুষ যা বোঝে সেটা প্রকৃত আমি নয়, সেটা কাঁচা আমি, তার জন্ম, স্থিতি এবং মৃত্যু আছে, কিন্তু পাকা আমির বা আত্মার জন্ম বা মৃত্যু নেই, অনন্ত স্থিতি আছে। এই সত্যটা সবার জন্য প্রযোজ্য, কিন্তু বোঝে কজন? আর কেউ বুঝুক না বুঝুক ধর্মীয় এবং রাজনৈতিক নেতা নেত্রীরা বুঝলেই হতো, কিন্তু তাদের বেশির ভাগ বোঝেনা, সেইজন্য সমস্যার সমাধান হয়না। 🙏

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *