১৯৭৩ সালে খুলনায় বেড়াতে আসেন একবার। শহরের বিভিন্ন জায়গায় গেছেন আর সবকিছু দেখে শিশুর মত কেঁদেছেন। ফিরে যাওয়ার সময় সঙ্গে করে নিয়ে গিয়েছিলেন খুলনার মাটি। কলকাতায় ফিরে পরিবারের সদস্যদের বলেছিলেন তাঁর মৃত্যুর পর চিতায় যেন ঐ মাটি দেওয়া হয়।
আমাদের ভারত, ৮ মে: দেশভাগের ফলে বাংলাদেশের বহু হিন্দুকে তাদের চৌদ্দপুরুষের ভিটে ছাড়তে হয়েছিল। অনেকেই রাতের অন্ধকারে পালিয়ে আসতে বাধ্য হয়েছিলেন। কিন্তু মন থেকে তাঁরা মেনে নিতে পারেননি। তাই বাকি জীবন পূর্বপুরুষের ভিটের কথা মনে করে চোখের জল ফেলেছেন। খুলনার জমিদার মহেন্দ্র কুমার ঘোষও একসময় চৌদ্দপুরুষের ভিটে ছাড়তে বাধ্য হয়েছিলেন। কিন্তু সারা জীবন তাঁকে বেদনা বয়ে বেড়াতে হয়েছে। শিকড়ের টানে একবার সেই পিতৃপুরুষের ভিটেতে গিয়ে শুধু চোখের জল ফেলেছিলেন। প্রথমবার ভিটে ছাড়ার সময় যা পারেননি সেবার তাই করেছিলেন, সাথে করে নিয়ে এসেছিলেন তাঁর পিতৃপুরুষের ভিটের পবিত্র মাটি।
১৮৮৯ সালের ১ অক্টোবর, মঙ্গলবার, খুলনা জেলার (বর্তমানে বাগেরহাট) নোয়াপাড়া গ্রামে জমিদার মহেন্দ্র কুমার জন্মগ্রহণ করেন। পিতার তিন পুত্রের মধ্যে তিনি ছিলেন জ্যেষ্ঠ।
তিনি মেধাবী ছাত্র ছিলেন। কৃতিত্বের সাথে এম.এ. বি. এল পাশ করে খুলনা জর্জকোর্টে আইনজীবী হিসেবে যোগদান করেন। তবে আইন ব্যবসা তাঁকে বেশি দিন ধরে রাখতে পারেনি। জনহিতকর কাজে তাঁর প্রবল আগ্রহ থাকায় ১৯২৫ সালে জানুয়ারি মাসে তিনি খুলনা মিউনিসিপ্যালিটির ভাইস-চেয়ারম্যান পদে অধিষ্ঠিত হন। অতঃপর ১৯২৮ সালে তিনি পৌরসভা চেয়ারম্যান হিসেবে যোগদান করেন। ১৮৮৪ সাল থেকে বর্তমান সময় পর্যন্ত সবথেকে বেশি সময় ধরে খুলনা শহরে ‘নগরপিতা’ থাকার কৃতিত্ব মহেন্দ্র কুমার ঘোষ-এর। তিনি প্রায় ২০ বছর নিরবচ্ছিন্নভাবে খুলনা মিউনিসিপ্যালটির চেয়ারম্যান ছিলেন।
১৯৪৮ সালে তিনি পাকাপাকিভাবে কলকাতায় চলে যান। ১৯৭৩ সালে খুলনায় বেড়াতে আসেন একবার। শহরের বিভিন্ন জায়গায় গেছেন আর সবকিছু দেখে শিশুর মত কেঁদেছেন। ফিরে যাওয়ার সময় সঙ্গে করে নিয়ে গিয়েছিলেন খুলনার মাটি। কলকাতায় ফিরে পরিবারের সদস্যদের বলেছিলেন তাঁর মৃত্যুর পর চিতায় যেন ঐ মাটি দেওয়া হয়। ১৯৭৭ সালের ১৫ জুলাই তিনি প্রয়াত হন।
‘সেভ দি হেরিটেজেস অফ বাংলাদেশ’ ফেসবুক গ্রুপের সাজ্জাদুর রশিদ জানিয়েছেন, “১৯৪০ সালের ১৮ই জুলাই এই জমিদার বাড়ির দুটি কক্ষে মাত্র সাত জন ছাত্রী নিয়ে যাত্রা শুরু করে রাজেন্দ্র কুমার (আর কে) মহিলা কলেজ, যা পরবর্তীতে আজকের খুলনা সরকারী মহিলা কলেজ হয়েছে। এটি ছিল দক্ষিণবঙ্গে একুশ জেলায় মেয়েদের জন্য স্থাপিত প্রথম উচ্চ মাধ্যমিক কলেজ। ঘোষ পরিবার ছিল বর্তমান বাগেরহাটের ফকিরহাট উপজেলার টাউন নওয়াপাড়ার জমিদার। বাগেরহাটের ফকিরহাট, মোল্লাহাট, রামপাল, মংলা, ডুমুরিয়া, কয়রা, বাটিয়া ঘাট অঞ্চলগুলো তাদের জমিদারিতে ছিল। মহেন্দ্র ঘোষ রায় বাহাদুর উপাধি পেয়েছিলেন। তার ভাই শৈলেন ঘোষ জমিদারী চালাতেন, যিনি তার প্রিয় কন্যা নীলার নামে ১৯৪১ সালে বাগেরহাটের নীল সরোবর দিঘি ও ১৯৪৫ সালে খুলনার দ্বিতীয় সিনেমা হল নীলা (পরবর্তীতে পিকচার প্যালেস) তৈরি করেন। ১৯৪৭ সালে মহেন্দ্র ঘোষ ছিলেন পৌরসভা চেয়ারম্যান, শৈলেন জেলা বোর্ডের চেয়ারম্যান। ৫১.২ ভাগ হিন্দু জনগোষ্ঠীর খুলনা ১৪-১৭ই আগস্ট, ১৯৪৭ এ ভারতে ছিল, যাতে এই দুই ভাই পতাকাও উত্তোলন করেন। খুলনার উঁচু বংশীয় মুসলিমদের অনেকই ছিলেন উর্দু ভাষী, মুর্শিদাবাদ হতে নির্বাসিত। তাদের বাউন্ডারি কমিশনে আবেদনের পর বাংলার বাউন্ডারি কমিশনে ছিলেন দু’জন মুসলমান বিচারপতি এস.এম আকরাম ও এম.এ রহমান আর দু’জন হিন্দু বিচারপতি সি সি বিশ্বাস ও বিজন মুখোপাধ্যায়। তারা কোনও সীমান্ত নির্ধারণে অস্বীকৃতি জানালে ও মুর্শিদাবাদের নবাব ভারতে যোগদানের ইচ্ছা প্রকাশ করলে রেডক্লিফ খুলনা জেলা পাকিস্তানে দিয়ে দেন।
সূত্র:- ‘ফাইন্ড দি হিস্ট্রি’ ব্যক্তিগত ব্লগ, খুলনা ইন্সটিটিউট।
সঙ্কলন— অশোক সেনগুপ্ত।