আমাদের ভারত, ৬ মে: রাজশাহীর গুরুত্বপূর্ণ দর্শনীয় স্থানের মাঝে অবশ্যই বরেন্দ্র রিসার্চ মিউজিয়াম অন্যতম। সম্পূর্ণ ব্যক্তিগত উদ্যোগে প্রতিষ্ঠিত এই জাদুঘরটি বাংলাদেশের প্রথম জাদুঘর এবং দক্ষিন এশিয়ার বৃহত্তম প্রত্নতাত্ত্বিক সংগ্রহশালা।
নাটোরের দিঘাপতিয়ার রাজপরিবারের বিদ্যোৎসাহী জমিদার কুমার শরৎকুমার রায়, খ্যাতনামা আইনজীবী ও ঐতিহাসিক অক্ষয় কুমার মৈত্রেয় ও রাজশাহী কলেজিয়েট স্কুলের শিক্ষক রমাপ্রসাদ চন্দ্রের প্রচেষ্টায় ১৯১০ সালে এই জাদুঘর প্রতিষ্ঠিত হয়। বাংলার শিল্পকলা ও প্রত্নতত্ত্ব সম্পর্কে অধ্যয়ন ও গবেষণায় তাঁদের অভিন্ন আগ্রহ ছিল। মানুষ ও প্রকৃতির ধ্বংসলীলা এড়িয়ে যেসব সৌধ এখনও টিকে আছে সেগুলির তথ্য উদ্ঘাটন করে অতীত ঐতিহ্য তুলে ধরাই ছিল তাঁদের প্রয়াস।
ভারতবর্ষে প্রাচীনকাল থেকেই শিল্পকলার একাধিক ঘরানা রয়েছে। এগুলোর মধ্যে বিখ্যাত হচ্ছে গান্ধার, সারনাথ, মথুরা, মগধ এবং বরেন্দ্র ঘরানা। বরেন্দ্র গবেষণা জাদুঘর বরেন্দ্র ঘরানাকে প্রতিনিধিত্ব করছে। ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষার্ধ থেকে তৎকালীন সচেতন মহল ইতিহাস, ঐতিহ্য, সাহিত্য, সংস্কৃতি সংরক্ষণ ও পুনরুদ্ধারের জন্য উৎসাহী হয়ে উঠেন, যার ফলে বিস্মৃত প্রায় সাহিত্যিক নিদর্শন এবং ঐতিহাসিক ও প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শনগুলো সংগ্রহ ও অনুশীলনের জন্য প্রতিষ্ঠিত হয় বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদ।
বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদের উদ্দেশ্যে অনুপ্রাণিত হয়ে পুরাকীর্তি সম্পর্কে উৎসাহী হয়ে উঠেন কুমার শরৎকুমার রায়। তারই ফলশ্রুতিতে ১৯১০ সালে তারা বগুড়া জেলার খঞ্জনপুরে পুরাতাত্ত্বিক অভিযানে যান এবং এর ঐতিহ্য সংগ্রহ ও সংরক্ষণের জন্য একটি সমিতি গঠনের বিষয়ে ঐকমত্য হয়ে গঠন করেন বরেন্দ্র অনুসন্ধান সমিতি।
সোসাইটির জাদুঘর ও গ্রন্থাগারের জন্য কুমার নিজ ব্যয়ে একটি ভবন নির্মাণ করেন এবং ভবনে প্রয়োজনীয় আসবাবেরও ব্যবস্থা করেন। তাঁর জ্যেষ্ঠ ভ্রাতা দিঘাপতিয়ার রাজা প্রমদনাথ রায় ভবন নির্মাণের জন্য জমি দান করেন। ১৯১১ সালে বরেন্দ্র গবেষণা জাদুঘরে সংগৃহীত সকল দুষ্প্রাপ্য ও অনন্য নমুনা কলকাতার ভারতীয় জাতীয় জাদুঘর দাবি করলে বরেন্দ্র জাদুঘরের অস্তিত্ব বিপন্ন হওয়ার উপক্রম হয়।
বাংলার তৎকালীন গভর্নর লর্ড কারমাইকেল ১৯১২ সালে রাজশাহীতে এসে সোসাইটির সংগ্রহগুলি দেখে মুগ্ধ হন। এর অল্পকাল পরেই বাংলার গভর্নর এক প্রজ্ঞাপন দ্বারা স্থানীয় জাদুঘরগুলির সংগঠকদের প্রত্নসম্পদ সংগ্রহ, সংরক্ষণ এবং সাধারণ্যে প্রদর্শনের অনুমতি দেন। লর্ড কারমাইকেল ১৯১৬ সালের ১৩ নভেম্বর এই ভবনের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন। ১৯১৯ সালের ২৭ নভেম্বর একটি অছিনামা সম্পাদিত হয় এবং ঐ একই দিন বাংলার তৎকালীন গভর্নর লর্ড রোনাল্ডসে জনসাধারণের জন্য এই জাদুঘর উন্মুক্ত করেন।
ভাস্কর্য, শিলালিপি, পান্ডুলিপি, মুদ্রা ও অন্যান্য প্রত্নতাত্বিক গুরুত্বসম্পন্ন সামগ্রী সংগ্রহের জন্য কুমার ও তাঁর সহযোগীরা বেশ কয়েকটি অনুসন্ধানমূলক সফরের আয়োজন করেন। সফরগুলি রাজশাহী, বগুড়া, রংপুর, ঢাকা, মালদহ, ২৪ পরগনা ইত্যাদি জেলার প্রত্নস্থলগুলিতে পরিচালিত হয়। এ সফরগুলি অত্যন্ত ফলপ্রসূ হয় এবং উল্লেখযোগ্য সংখ্যক প্রত্ননিদর্শন আবিষ্কৃত, শনাক্তীকৃত ও সংগৃহীত হয়। ১৯২৩ সালে বরেন্দ্র সোসাইটি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় এর সহযোগিতায় ও অধ্যাপক ডি.আর ভান্ডারকরের নির্দেশনায় পাহাড়পুরে খননকার্য শুরু করে।পাহাড়পুরে উৎখননের ফলে যে সব প্রত্ননিদর্শন পাওয়া যায়, তার মধ্যে বরেন্দ্র জাদুঘর তার প্রাপ্য অংশ হিসেবে আর্কিওলজিক্যাল সার্ভে অব ইন্ডিয়ার কাছ থেকে ২৬৫টি নিদর্শন পায়।
বর্তমানে জাদুঘরটি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের তত্বাবধানে পরিচালিত হচ্ছে। প্রতিষ্ঠার পর থেকে জাদুঘর থেকে বিভিন্ন সময়ে হারিয়ে গেছে প্রায় তিন হাজার দুর্লভ প্রত্নসামগ্রী। তবে জাদুঘরের এ পর্যন্ত সংগ্রহ সংখ্যা সাড়ে আট হাজারেরও বেশি। এর মধ্যে প্রায় দেড় হাজার প্রস্তর ও ধাতবমূর্তি, ৬১টি লেখচিত্র, দুই হাজারেরও বেশি প্রাচীন মুদ্রা, ৯০০’র বেশি পোড়ামাটির ভাস্কর্য-পত্র-ফলক, প্রায় ৬০টি অস্ত্র-শস্ত্র, ৩০টির মতো আরবি-ফার্সি দলিল, মোগল আমল থেকে ব্রিটিশ আমল পর্যন্ত বিভিন্ন প্রকারের রৌপ্য-ব্রোঞ্জ-মিশ্র ধাতুর প্রায় ৪০০টি মুদ্রা রয়েছে এখানে। এছাড়া প্রায় সাড়ে চার হাজারেরও বেশি পাণ্ডুলিপি আছে। এসব সংগ্রহ মোট ১৪টি গ্যালারিতে দর্শকদের জন্য উন্মুক্ত।
তথ্য ও ছবি— সোহেল মাহবুবুর
সুত্র: বাংলাপেডিয়া, বাংলাদেশ জাতীয় তথ্য বাতায়ন, রাজশাহী জেলা, বাংলানিউজ ডট কম।
সংকলন— অশোক সেনগুপ্ত।