ভূত চতুর্দশী, চৌদ্দ শাক এবং শাক সংস্কৃতি

ছবি: (উপরে) ওল শাক।
ড. কল্যাণ চক্রবর্তী
আমাদের ভারত, ৩ নভেম্বর: ভূত চতুর্দশীর দিন চৌদ্দ শাক খেতে হয় আর সন্ধ্যাবেলায় চৌদ্দ প্রদীপ জ্বালাতে হয়। কিন্তু আমরা বেশীর বাজার থেকে রেডিমেড চৌদ্দ শাক খেতে অভ্যস্থ। কিন্তু তাতে সঠিক উপাদান থাকে না। তাই এই চৌদ্দ শাক খাওয়ার পুরো উপকার আমরা পাই না। কারণ, আমরা অনেকেই জানি না যে এই চোদ্দ শাকের মধ্যে কি কি শাক থাকে বা থাকা দরকার, যাতে আগামী দিনে ঋতু পরিবর্তনের জন্য যে যে রোগ ব্যাধি হওয়ার সম্ভাবনা থাকে তার প্রতিরোধ ক্ষমতা শরীরে তৈরী হয়।

ভূত চতুর্দশীতে ( ভূত তাড়াতে) যে চৌদ্দ শাক আমরা খাই তার মধ্যে আছে ওল, কেঁউ, বেতো বা বাথুয়া, কালকাসুন্দে, সরিষা, নিম, জয়ন্তী, শালিঞ্চ বা শাঞ্চে, গুড়ুচি বা গুলঞ্চ, পটুক বা পটল বা পলতা পাতা, শেলূকা, হিলমোচিকা বা হিঞ্চে, ভন্টাকী বা ঘেঁটু বা ভাট এবং সুনিষণ্নক বা সুশনি।


ছবি: কেউ শাক।

মানভূম অঞ্চলে জীহুড় দিনে (আশ্বিন সংক্রান্তি) ২১ রকমের শাক রান্না করে খাওয়ার বিধি আছে। এই শাকগুলির নাম — ওল, কেঁউ, বেতো, সরিষা, কালকাসুন্দা, নিম, জয়ন্তী, শাঞ্চে, হিলঞ্চ, পলতা, শোলফা, গুলঞ্চ, ভাঁট, সুষনি, কলমি, কুদ্রুং, কুলেখাড়া, থানকুনি, ব্রাহ্মী, বাসক এবং কালমেঘ।


ছবি: কালকাসুন্দা শাক।

কার্তিক পুজোর সময় যে শস্য-সরা রচনা করা হয়। তাতে ছোলা, মটর, সরষে, গম, মাষ-কলাই-এর পাশাপাশি কচু ও সুশনি শাকের চারাও লাগানো হয়। এইভাবে ‘অ্যাডোনিস গার্ডেন’ ধারণা সংস্কৃতির অঙ্গ হিসাবে আমাদের উদ্যান রচনা করতে শেখায়। বাংলার কুমারী মেয়েরা কার্তিক মাস জুড়ে যমপুকুর ব্রত উৎযাপন করত। বাড়ির উঠোনে চৌকো পুকুর কেটে তার পাশে লাগাতো কলমি, সুশনি, হিংচে, কচু, হলুদ। পুতুল বসতো পুকুরের পশ্চিম পাড়ে — কাক, বক, হাঙর, কুমির আর কচ্ছপ। পুকুরে জল ঢেলে বলা হত ছড়া “সুশনি-কলমি ল-ল করে রাজার বেটা পক্ষী মারে… কালো কচু, সাদা কচু ল-ল করে, রাজার বেটা পক্ষী মারে।” এই ব্রতের মাধ্যমে কুমারীদের শাক-সবজির বাগান তৈরিতে উৎসাহ যোগাতো।


ছবি: জয়ন্তী শাক।

কবি কঙ্কণ চণ্ডীতে নিদয়ার সাধভক্ষণ অংশে নানান শাক রান্নার কথা আছে–
“আমার সাধের সীমা হেলাঞ্চি কলমী গিমা বোয়ালী কুটিয়া কর পাক।
ঘন কাটি খর জ্বালে সাঁতলিবে কটূ তেলে দিবে তাতে পলতার শাক।।
পুঁই-ডগা মুখী-কচু তাহে ফুলবড়ি কিছু আর দিবে মরিচের ঝাল।।”

কবি কঙ্কণ চণ্ডীতে ‘নিদয়ার মনের কথা’ অংশে রয়েছে– “বাথুয়া ঠনঠন তেলের পাক ডগি ডগি লাউ ছোলার শাক।।”

মা লক্ষ্মীর ভাণ্ডার বলতে, গ্রাম-বাংলার সমৃদ্ধি বলতে বুঝতে হবে আহার ও পুষ্টির একটি গুরুত্বপূর্ণ সংযোগ। সমৃদ্ধি তখনই বলবো যখন গ্রামবাসী রোজ দু’বেলা পুষ্টিকর খাবার পাতে পাবেন। কেউ দয়া করে ভিক্ষে দিয়ে সমৃদ্ধি আসে না।

যাদের বাড়িতে এক চিলতে জমি আছে; তাতে ভালো আলো-বাতাস খেলে, তারা করতে পারবেন পুষ্টি বাগান। বাগানের বর্জ্য, তরকারির খোসা, মাছের কাঁটা, মাংসের হাড় ইত্যাদি ব্যবহার করে বাগানেই বানিয়ে নেওয়া যায় কম্পোস্ট সারের ভাণ্ড। গ্রামের মানুষ গোবর ও গোমূত্র ব্যবহার করে গোবর সার, তরল জৈবসার এবং কেঁচো ব্যবহার করে ভার্মি-কম্পোস্ট বা কেঁচোসার বানিয়ে এই পুষ্টিবাগানে প্রয়োগ করতে পারেন। এরফলে কৃষির রাসায়নিক দূষণ থেকে রেহাই পাওয়া যাবে। কারণ সবজি আর ফলেই সবচাইতে বেশি সার, কীটনাশক ও ছত্রাকনাশক ব্যবহার করা হয়।

বাড়ির পড়ুয়া ছাত্র-ছাত্রী ও গৃহকর্ত্রীরাই মিলেমিশে রচনা করবেন এই বাগান। পুষ্টি বাগানের ফসল চক্র: প্লট -১: জলদি ফুলকপি এবং সাথি ফসল রূপে পালং শাক (আষাঢ় থেকে আশ্বিন), আলু (কার্তিক থেকে ফাল্গুন), নটেশাক (চৈত্র থেকে আষাঢ়) প্লট -২ : নাবি বাঁধাকপি (আশ্বিন থেকে মাঘ), ভিণ্ডি (ফাল্গুন থেকে আষাঢ়), মুলো (আষাঢ় থেকে ভাদ্র) প্লট -৩: ফুলকপির সঙ্গে সাথি ফসল ওলকপি (আশ্বিন থেকে মাঘ), গ্রীষ্মকালীন বেগুন সঙ্গে সাথি ফসল নটে শাক (ফাল্গুন থেকে ভাদ্র) প্লট -৪: জলদি বাঁধাকপি সঙ্গে সাথি ফসল পালং (ভাদ্র থেকে অঘ্রাণ), মটরশুঁটি (পৌষ থেকে বৈশাখ), বরবটি (জ্যৈষ্ঠ থেকে শ্রাবণ) প্লট – ৫: জলদি ফুলকপি সঙ্গে সাথি ফসল লালশাক (শ্রাবণ থেকে কার্তিক), পিঁয়াজ (অঘ্রাণ থেকে জ্যৈষ্ঠ), বরবটি (জ্যৈষ্ঠ থেকে শ্রাবণ) প্লট – ৬: ভিণ্ডি (শ্রাবণ থেকে অঘ্রাণ), আলু (অঘ্রাণ থেকে ফাল্গুন), বরবটি (চৈত্র থেকে আষাঢ়) প্লট – ৭: টমেটো (কার্তিক থেকে ফাল্গুন), ভিণ্ডি (বৈশাখ থেকে ভাদ্র), মুলো (ভাদ্র থেকে কার্তিক) প্লট – ৮: বরবটি (ভাদ্র থেকে কার্তিক), পেঁয়াজ (অঘ্রাণ থেকে বৈশাখ), লালশাক (জ্যৈষ্ঠ থেকে শ্রাবণ) প্লট – ৯: লালশাক (কার্তিক থেকে অঘ্রাণ), টমোটো (অঘ্রাণ থেকে বৈশাখ), উচ্ছে (বৈশাখ থেকে আশ্বিন) প্লট – ১০: বেগুনের সঙ্গে সাথি ফসল পালং (আষাঢ় থেকে ফাল্গুন), নটে শাক ( চৈত্র থেকে জ্যৈষ্ঠ) প্লট -১১: পেঁয়াজ (কার্তিক থেকে বৈশাখ), ভিণ্ডি (জ্যৈষ্ঠ থেকে আশ্বিন) প্লট -১২: লম্বালম্বিভাবে অনুচ্চ ফলের গাছ লাগানো হবে, যেমন আম্রপালি আম, এল-৪৯ পেয়ারা, গ্র্যান্ড নাইন কলা, করমচা, ডালিম।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *