স্বামী প্রৌঢ়ানন্দ
আমাদের ভারত, ৬ ফেব্রুয়ারি: ট্রেনের সিটে বসে ঝিমুতে ঝিমুতে কখন যে ঘুমিয়ে পড়েছি খেয়াল নেই। যখন ঘুম ভাঙল দেখি পুব দিক লাল হয়ে গেছে। আমার ডানদিক আর বাম দিকের কাঁধে দুজনের মাথা। আমি একটু সরলেই দুজনে পড়ে যাবে, তাই এখন আমি স্থানুবৎ বসে আছি। বেশ কিছুক্ষণ পর তারা জাগলেন আর আমিও বন্ধন থেকে মুক্ত হলাম।
প্রথমেই ছুটলাম রাতের দেখা সাধুবাবার কাছে, কিন্তু পৌঁছে দেখি সেখানে কেউ নেই, সাধুবাবা গেলেন কোথায়, ওনার তো হরিদ্বার যাবার কথা। আশেপাশের কয়েকজন যাত্রীকে জিজ্ঞাসা করলাম, তারাও কিছু বলতে পারলেন না। নিরাশ হয়ে ফিরে গেলাম নিজের আসনে।
সকাল আটটার সময় হরিদ্বার পৌঁছে যাবার কথা, কিন্তু ট্রেন লেট আছে, শোনা গেল ১০টা নাগাদ হরিদ্বার পৌঁছবে।অমরদা কালকের রাতে সেই যে উপরে উঠে শুয়েছেন আর নামার নাম নেই, মনে হয় একেবারে হরিদ্বারে পৌঁছে গিয়ে তবে নামবেন। খিদেও পেয়েছে, কিন্তু ট্রেনে কোনো হকার ভাইকে দেখছি না। আসার সময় আমারই এক পরমাত্মীয় আমায় কিছু ঢেকুয়া বানিয়ে দিয়ে ছিলেন, এটি ময়দার সাথে চিনি মিশিয়ে শক্ত বিস্কুটের মতো, খেতে দারুণ সুস্বাদু হয়। এই ঢেকুয়া দিয়েই আমাদের জলযোগ সারা হল।
ইতিমধ্যে আমাদের ট্রেন হরিদ্বারের আগে জ্বালা বলে একটি স্টেশনে এসে দাঁড়িয়েছে। যাক এর পরের স্টেশনই হরিদ্বার, আমার স্বপ্নের শহর, আমার কত দিনকার দর্শনের
বাসনা আজ পুর্ন হতে চলেছে।
জ্বালা স্টেশনে ট্রেন দাড়িয়ে আছে, দশ মিনিট কুড়ি মিনিট করে প্রায় এক ঘন্টা হয়ে গেল ট্রেন আর নড়ে না। শুনলাম কুম্ভমেলার জন্য বহু স্পেশাল ট্রেন চলাচল করার জন্য আমাদের ট্রেনটি লাইন ক্লিয়ার পাচ্ছে না। এদিকে প্রচন্ড গরম, দেখলাম অনেকেই ট্রেন থেকে নেমে রেল লাইনের পাশের কল থেকে জল নিয়ে গায়ে ঢালছে। তাদের দেখা দেখি আমরাও একটা গামছা ভিজিয়ে মুখে, হাতে, পায়ে জল দিয়ে মুছলাম। ঐ গরমে যখন আমাদের একেবারে পাঁপড় ভাজার মতন অবস্থা ঠিক তখনই ট্রেন ছাড়ার হুইশেল দিল আর আমরাও জ্বালা স্টেশনের জ্বালার হাত থেকে মুক্তি পেলাম।
অবশেষে এলাম হরিদ্বার। বহু বছরের মনের মধ্যে সঞ্চিত আশা হরিদ্বারের পুণ্য ভূমি দর্শন আজ পুর্ন হল। স্টেশন থেকে বেরিয়ে পুণ্য ভূমির মাটি কপালে আর মাথায় ধারন করলাম। পুরাকালে হরিদ্বারকে বলা হত মায়াপুরী। কথিত আছে, ময়দানব এই পুরী নির্মান করেন। হরিদ্বারকে হরদুয়ার বা হর কা দুয়ার ও বলা হয়ে থাকে। হরি হলেন শ্রীবিষ্ণু আর হর হলেন বাবা মহাদেব। হরিদ্বার হল হিমালয়ের প্রবেশ দ্বার, আর হিমালয় হল শ্রীবিষ্ণু এবং বাবা মহাদেবের আলয়। সেই অর্থে শৈব এবং বৈষ্ণব উভয়েরই পবিত্র তীর্থ ক্ষেত্র এই হরিদ্বার। বহু প্রাচীন মন্দির, পুরান খ্যাত মন্দির রয়েছে এই হরিদ্বারে। কঙ্খলে রয়েছে দক্ষপ্রজাপতির মন্দির। মাতা সতীর দেহত্যাগের কথা সকলেই জানেন। পতির অর্থাৎ মহাদেবের অপমান সইতে না পেরে সতীমাতা আত্মহূতী দেন। সতী বিরহ সইতে না পেরে মহাদেব ক্রোধে উন্মত্ত হয়ে যান। দক্ষ রাজকে মহাদেব বধ করেন শিবমেররোষানলে ত্রিলোক কম্পিত হয়, সৃষ্টি রসাতলে যাবার উপক্রম হয়। এমতাবস্থায় এগিয়ে আসেন শ্রীবিষ্ণু, তিনি তাঁর সুদর্শন চক্রের দ্বারা সতীমাতার দেহ ৫১টি খণ্ডে খণ্ডিত করেন। এই ৫১টি খণ্ড যেখানে যেখানে পড়েছে সেখানেই গড়ে উঠেছে এক একটি সতীপীঠ।হিমালয়ের কোলেও রয়েছে এই রকম বেশ কয়েকটি সতীপীঠ। এই পীঠগুলি সাধকদের সাধন স্থল।
স্টেশন থেকে বেরিয়ে দেখি লোকে লোকারন্য। কুম্ভমেলার ভিড় সমগ্র হরিদ্বার জুড়ে। চারদিকে শুধু কালো মাথা গিজ গিজ করছে। মহাকুম্ভে পুন্যস্নানের উদ্দেশ্যে সকলে এখানে এসেছেন। প্রতি বারো বছর অন্তর হয় পূর্ন কুম্ভ আর ছয় বছর ছাড়া ছাড়া হয় অর্ধ কুম্ভ।বসমুদ্র মন্থনে ওঠে অমৃতের কলস। এই অমৃতপান যিনিই করবেন তিনিই অমর হয়ে যাবেন। এই অমৃতের ভাগ নিয়ে শুরু হয় দেবতা আর দৈত্যের মধ্যে তীব্র সংঘাত। ইত্যবসরে ইন্দ্র পুত্র জয়ন্ত অমৃতের কলসটি নিয়ে পালিয়ে যান। পালিয়ে যাবার পথে এই ভারি কলসিটি তিনি মোট চারিটি জায়গায় নামিয়ে রাখেন এবং এই চারটি জায়গাতে একটু করে অমৃত ছলকে পড়ে, তাই পৌরানিক শ্রুতি অনুযায়ী এই স্থানে বিশেষ যোগে স্নান করলে সহস্র অশ্বমেধ যজ্ঞের ফল পাওয়া যায়।এই চারটি জায়গা হল হরিদ্বার, নাসিক, উজ্জয়িনী এবং এলাহাবাদ। প্রতি বারো বছর অন্তর এই চারটি জায়গাতেই হয় পুর্নকুম্ভমেলা।
এই জনঅরন্যে শুধুই ঠাঁই নেই ঠাঁই নেই রব। ভিড় সামলানোর জন্য প্রশাসন থেকে বাঁশের ব্যারিকেড দিয়েছে, তাই এক মাইল রাস্তা পেরোতে চার মাইল রাস্তা অতিক্রম করতে হচ্ছে। ভারী ব্যাগ নিয়ে প্রায় ঘন্টা দুয়েক হাঁটার পর নদীর ব্রিজ পেরিয়ে যখন নীল গঙ্গার তীরে এসে পৌছাঁলাম তখন কয়েকটি তাবুর দেখা পেলাম। অপেক্ষাকৃত ভাবে এখানে ভিড় খানিকটা কম।
একটি তাবুর সামনে গিয়ে দেখলাম একজন গেরুয়াধারী আরাম করে শুয়ে আছেন আর একজন ষোলো কি সতেরো বছরের বালিকা তার পদসেবা করছেন। আমাদের দেখে উনার কোনও ভাবান্তর হল না, তেমনই শুয়ে রইলেন।থাকার কথা জিজ্ঞাসা করতে বললেন, থাকতে দিতে পারি কিন্তু কোনও কম্বল দিতে পারব না। এই ভিড়ের বাজারে তাই সই। একজন কমবয়সী তরুণ চললেন আমাদের জায়গা দেখাতে। গিয়ে দেখি মাটির উপর খড় বিছানো আর তার উপর নোংরা সতরঞ্চী পাতা। দীর্ঘ পথশ্রমে ক্লান্ত হয়ে ওখানেই আমরা বসে পড়লাম। এখন প্রায় দুটো বাজে, খিদেতে পেট চুইচুই করছে, পুনরায় সেই গেরুয়া ধারী ব্যক্তির কাছে গিয়ে খাবার কথা জিজ্ঞাসা করতে বললেন, এখন কোনও খাবার নেই, খেতে হলে দুপুর বারোটা আর রাত নটার মধ্যে খেতে হবে। অমোঘ এই নিয়মের কোনও ব্যতিক্রম নেই। বলাই বাহুল্য তাবুতে থাকার জন্য আমাদের কাছে জন পিছু তৎকালীন মূল্যে তিনশো করে টাকা নেওয়া হয়েছিল। যাইহোক খাবারের সন্ধানে বাইরে গেলাম।খানিকটা গিয়ে দেখি এক পাঞ্জাবি লঙ্গরখানা, ভাত আর রাজমার ঝোল খাওয়ানো হচ্ছে। সেখানেই দাড়িয়ে পড়লাম। খিদের চোটে তাই মনে হল অমৃত। খাওয়া শেষ হলে পুনরায় তাবুতে ফিরে এলাম। দীর্ঘ পথশ্রমে সকলেই ক্লান্ত, শুয়ে পড়লাম। সিদ্ধান্ত হল কাল সকালে কুম্ভ স্নান সেরে আর এখানে নয়, আমরা হৃষিকেশ রওনা দেব।