স্বামী প্রৌঢ়ানন্দ
আমাদের ভারত, ১৩ ফেব্রুয়ারি: ফাঁকা মাঠে ঐ তাবুতে আমরা কয়জন। হুহু করে ঠান্ডা হাওয়া বইছে। হরিদ্বার যারা গেছেন তারা জানেন দিনের বেলায় সেখানে গরম হলেও রাতের বেলা প্রচন্ড ঠান্ডা পড়ে। ঐ ঠান্ডার মধ্যে আমাদের সম্বল সাথে করে নিয়ে আসা চাদর। শোয়েটার আর মাফলারের সাথে তাই জড়িয়ে শুয়ে আছি। কাল সকালেই কুম্ভ স্নানের যোগ, তাই ভোর চারটে থেকেই লাইনে দাঁড়িয়ে পড়তে হবে। সারাদিনের প্রচন্ড ক্লান্তিতে ঢলে পড়লাম ঘুমের কোলে।
ভোর চারটের সময় ঘুম থেকে উঠে স্নান করার জন্য তৈরি হয়ে বেরিয়ে পড়লাম। ঠান্ডায় কাঁপতে কাঁপতে এগিয়ে চলেছি হর-কি-পৌরি ঘাটের দিকে। সঙ্গে আরও বহু লোক চলেছে পুন্যস্নানের উদ্দেশ্যে। অনেকটা হাঁটার পর পৌঁছে গেলাম হর-কি-পৌরি ঘাটে। সকাল ছ’টা থেকে পুন্য স্নান শুরু হবে। এখন বাজে ভোর পাঁচটা। বাঁশের খুঁটি দিয়ে প্রত্যেকটি ঘাট আলাদা করে দেওয়া হয়েছে। আমাদের আশা ব্রহ্ম কুণ্ডে স্নান করার। কিন্তু যেখানে দাঁড়িয়ে আছি সেখান থেকে ব্রহ্ম কুণ্ডে যাবার সম্ভাবনা নেই বললেই চলে।প্রতিটি ব্যারিকেডের কাছে অসংখ্য পুলিশ, গলে যাবার কোনও উপায় নেই। মন খারাপ করে দাঁড়িয়ে আছি, ঠাকুরকে স্মরণ করছি। আঁধার কেটে আলো ধীরে ধীরে ফুটে উঠছে। সেই আলোতে দেখলাম এক জটাজুটধারি সন্ন্যাসী সামনে গঙ্গা মাতার দিকে এক দৃষ্টে তাকিয়ে আছেন। চোখ দুটি তার অসম্ভব উজ্জ্বল, এক মায়াময় আবেশ। সামনে গিয়ে প্রণাম করতেই আমাদের দিকে তাকালেন। কী অন্তর্ভেদী সে দৃষ্টি, মনে হল এক নিমেষে ভিতরের সবটুকু দেখে নিলেন। মুখে কোনও কথা বললেন না, ইশারায় আমাদের তাঁর সঙ্গে যেতে নির্দেশ দিলেন।আমরাও মন্ত্র মুগ্ধের মতন তাঁর পিছনে চলতে লাগলাম। বেশ কিছুক্ষণ একটা আবেশের মধ্যে চলতে লাগলাম।কোথায় যাচ্ছি, কোথা দিয়ে যাচ্ছি কোনও হুঁশ নেই। যখন হুঁশ ফিরল তখন দেখি ব্রহ্ম কুণ্ডের সামনে দাঁড়িয়ে আছি।সেই সাধুবাবাকে আর দেখতে পাচ্ছিনা, তিনি যেন ভিড়ের মাঝে হারিয়ে গেছেন। সেদিনের ঘটনা আজও মনে পড়লে শিহরিত হয়ে উঠি।
বেশ মনে পড়ে যখন সেদিন সাধুবাবার পিছনে যাচ্ছিলাম আশেপাশে অতো ভিড় বা মানুষজন চোখে পড়েনি আর, বাঁশের কোনও বাধাও পেরোতে হয়নি।
কুম্ভ স্নান সেরে আবার তাবুতে ফিরে এলাম। মনের মধ্যে এক অফুরন্ত আনন্দ অনুভব করছি, মনে হল বাবামহাদেব স্বয়ং তাঁর ভক্তদের কৃপা করে করুনা বারিতে সিক্ত করলেন। যাইহোক পোশাক পরিবর্তন করে নিজেদের ব্যাগপত্তর নিয়ে তাবু থেকে বেরিয়ে এলাম। এখান থেকে আজই আমরা হৃষিকেশ রওনা দেব। আমাদের বাসনা হিমালয়ের গভীরে প্রবেশ করা। সামান্য কিছু জলযোগ করে একটি অটোতে চেপে রওনা দিলাম হৃষিকেশের উদ্দেশ্যে।
ঘন্টা খানেক পর হৃষিকেশ এসে পৌছাঁলাম। বাস স্ট্যান্ডের কাছেই একটি হোটেলে উঠলাম। হোটেলেটি বেশ পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন। হোটেলে সমস্ত কিছু রেখে গেলাম বাস স্ট্যান্ডে, কালকের ভোরের বাসের টিকিট কাটতে উত্তর কাশি যাবার জন্য। টিকিট কাটা হয়ে গেলে হৃষিকেশ দেখতে বেরিয়ে পড়লাম। কিছুটা দূরেই রামঝোলা, লক্ষণ ঝোলা,গঙ্গার দুই পারকে যুক্ত করেছে। ওপারে স্বামী শিবানন্দ সরস্বতীর যোগাশ্রম। আরও অনেক মঠ ও মন্দির রয়েছে এই হৃষিকেশে। এখানে নদীতে প্রচুর মাছ, একটু মুড়ি বা আটা ফেললেই মৎস্যকুল ধেয়ে আসছে। এখানে লঞ্চে করেও নদী পারাপারের ব্যবস্থা আছে। আমরাও ওপারে যাওয়ার জন্য লঞ্চে সওয়ার হলাম। এখানে ওখানে ঘুরতে ঘুরতে কখন যে বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা হয়ে যাবার উপক্রম হয়েছে খেয়াল নেই। গঙ্গা মাতার আরতি দেখে যখন হোটেলে ফিরলাম রাত আটটা বেজে গেছে। হাতমুখ ধুয়ে অল্প কিছু খেয়ে নিদ্রাদেবীর আরাধনায় মগ্ন হলাম। কাল ভোর পাঁচটার বাসে আমাদের টিকিট উত্তর কাশি যাবার।
ঠিক সময়ে বাস ছেড়ে দিল। এই সব পাহাড়ি পথে সকাল সকাল বাস ছেড়ে বিকেলের মধ্যেই গন্তব্যে পৌঁছে যায়। সেই মতন আমরাও আশা করছি বিকেলের মধ্যেই উত্তরকাশি পৌঁছে যাব।
পাহাড়ি পথ ধরে বাস উপরে উঠতে শুরু করল। ধীরে ধীরে বাসে স্থানীয় বাসিন্দাদের ভিড় বাড়তে লাগল। কেউ মাথায় বোঝা নিয়ে, কেউ বা গৃহস্থালির জিনিষপত্র নিয়ে চেপে বসেছেন। তবে সব চাইতে মজা হল যখন স্থানীয় এক ব্যক্তি একটি ছাগল নিয়ে বাসে উঠতে গেল। কন্ডাক্টর কিছুতেই উঠতে দেবেন না আর ঐ ব্যক্তি ছাগল নিয়ে উঠবেনই। শেষে রফা হল ছাগলটির জন্য অতিরিক্ত কুড়ি টাকা বেশি দিতে হবে। ছাগলটিও তারস্বরে ব্যা ব্যা করে চেঁচিয়ে যাচ্ছে। বাসের ভেতরে সে এক তালগোল পাকানো অবস্থা। যারা স্থানীয় নিত্যযাত্রী তাদের কোনও বিকার নেই, তারা এতেই অভ্যস্ত। এই বাসের ইঞ্জিনের আওয়াজও বিকট বিশেষত বাস যখন উপরে উঠছে তখনই ইঞ্জিনের শব্দে কান পাতা দায়।
বাস যতই উপরে উঠতে থাকে হিমালয় ততই নিজের রূপ মাধুরী প্রকাশ করতে থাকে। মনে হয় যেন এ পাহাড়ের কোনও শেষ নেই। নীচের রাস্তাগুলোকে ছোট দেখাচ্ছে, নীচের ছেড়ে আসা গ্রামগুলোকে ছবির মতন সুন্দর লাগছে। মাঝে মাঝেই কিছু জায়গায় চাষের জমি চোখে পড়ছে। বেশ খানিকক্ষণ পরে এক জায়গায় বাস থামলে কন্ডাক্টর বললেন, এখানে বাস আধ ঘণ্টা দাঁড়াবে, আপনারা চাইলে এখানে টিফিন করে নিতে পারেন। প্রায় সকলেই বাস থেকে নেমে পড়ল, তার সাথে সাথে আমরাও নেমে এলাম। কাছেই একটি দোকানে গরম গরম পুরি ভাজা হচ্ছিল। চা সহযোগে পুরি উদরস্থ করে আবার আমরা বাসে উঠে এলাম। একটু পরেই ড্রাইভার আর কন্ডাক্টরও উঠে এলেন। ইঞ্জিন আবার স্বমহিমায় ঘোষণা করল সে যাবার জন্য তৈরি।