তীর্থে তীর্থে পথে পথে, গঙ্গোত্রী ধাম দর্শন (অষ্টম পর্ব)

স্বামী প্রৌঢ়ানন্দ
আমাদের ভারত, ৩০ ফেব্রুয়ারি: প্রায় সাত থেকে আট ঘন্টা বাস ভ্রমণের পর এসে পৌছলাম উত্তর কাশি বাস আড্ডায়।
উত্তরকাশী শব্দটির অর্থ হলো উত্তরের কাশী। এটি ভারতের উত্তরাখণ্ডের একটি জেলা শহর এবং এই জেলার সদর দপ্তর। সমুদ্রতল থেকে ১১৫৮ মি. উচ্চতায় ভাগীরথী নদীর তীরে এই শহরের অবস্থান। এখানে অসংখ্য মন্দির এবং আশ্রমের দেখা পাওয়া যায়। এছাড়া নেহরু ইনস্টিটিউট অফ মাউন্টেনিয়ারিং এই শহরেই অবস্থিত। প্রথম ভারতীয় মহিলা হিসাবে বাচেন্দ্রি পাল এভারেস্টে আহরণ করেন, তিনি এই কলেজেরই ছাত্রী ছিলেন।

বরুনা ও অসিনদীর সঙ্গমস্থলে এই শহরের অবস্থান।উত্তরকাশী হিমালয়ের একটি অত্যন্ত প্রাচীন তীর্থক্ষেত্র।অসংখ্য সাধুসন্ত এখানে সাধনা করেছিলেন এবং এখনও উজালী নামক স্থানে সাধু সন্তদের আস্তানা রয়েছে। পবিত্র এই তীর্থক্ষেত্রকে অর্ধচন্দ্রাকারে বেষ্টন করে বয়ে চলেছে উত্তরবাহিনী গঙ্গা।

উওর কাশির প্রধান আকর্ষণ বাবা বিশ্বনাথের মন্দির। বাবা কেদারনাথের মন্দিরের আদলে তৈরি এই বিশ্বনাথ মন্দির।এই মন্দিরের প্রবেশদ্বারের পরে ডান দিকে আছে প্রাচীন গণেশ মন্দির। মন্দির চত্বরের ডান দিকে টিনের ছাউনির নীচে অনেকগুলো যজ্ঞ কুণ্ড আছে। এর বিপরীতের মন্দিরটি শক্তিমন্দির নামে অভিহিত। এই মন্দিরের ভিতরে একটি ত্রিশূল পোঁতা আছে। এই মন্দিরের সামনেই বিশ্বনাথ মন্দিরের অবস্থান। মন্দিরের প্রথম অংশে আছে বিশ্বনাথের বাহন নন্দীর কালো পাথরের মূর্তি। এর পরের অংশে আছে শ্রীবিশ্বনাথের শিবলিঙ্গ। এটি গোলাকার কালো পাথরের এবং এটি একটু বাঁ দিকে হেলানো। স্থানীয় নিত্য পুরোহিতের বক্তব্য অনুসারে এই লিঙ্গটি স্বয়ম্ভু। প্রায় ৫৫০ বছর আগে এই মন্দিরটি নির্মিত হয়েছিল বলে মনে করা হয়।

যাইহোক এখান থেকে খোঁজ করে গেলাম কালীকমলি ধর্মশালায়। শুনেছি ওখানেই কম খরচে থাকার জায়গা মেলে। ওখানে গিয়ে তিন জনের থাকার মতন একটি ঘর আমাদের পছন্দ হল, দৈনিক ভাড়া দেড়শ টাকা। অনেক অনুনয় বিনয় করেও আর কমানো গেল না। অগত্যা তাতেই রাজি হতে হল।
রুমে গিয়ে হাত মুখ ধুয়ে, ব্যাগপত্তর রেখে বেরিয়ে পড়লাম। বেশ কিছুক্ষণ এদিক ওদিক ঘোরাঘুরির পর গিয়ে বসলাম গঙ্গার ঘাটে। প্রায় বিকেল হয়ে গেছে, দেখলাম গঙ্গায় স্নান করে সিক্ত বসনে এক সন্ন্যাসী উঠে আসছেন। উঠে ঘাটের উপর রাখা ঝোলা থেকে শুকনো কাপড় বের করে পরে নিলেন। এর পর মা গঙ্গার দিকে মুখ করে বসলেন চোখ বন্ধ করে। প্রায় ঘন্টাখানেক কেটে গেল কিন্তু সাধুবাবার ধ্যান ভাঙে না। অনেকক্ষণ পর তিনি চোখ খুললেন। কাছে গিয়ে প্রনাম করে বসতেই হাত তুলে আশীর্বাদ করলেন।সাধুবাবাকে জিজ্ঞাসা করলাম বাবা কোথা থেকে আসছেন। বাবা স্মিত হেসে জবাব দিলেন আজকেই আমি গঙ্গোত্রী ধাম দর্শন করে নেমে এসেছি। শুনে অবাক হয়ে গেলাম।বললাম শুনেছি অক্ষয়তৃতীয়ার আগে চারধামের রাস্তা বন্ধ থাকে, তবে আপনি গেলেন কি করে! জবাবে বাবা হাসলেন। বললেন তোদের সাধারন মানুষের রাস্তা দিয়ে আমরা যাতায়াত করি না, আমরা জঙ্গলের বুক চিরে যাতায়াত করি। এখানে চারধাম আমরা হেঁটেই যাতায়াত করি। অবাক বিস্ময়ে সাধুবাবার মুখের দিকে তাকিয়ে রইলাম। করজোড়ে বাবার কাছে জানতে চাইলাম বাবা আমরা কি গঙ্গোত্রী ধাম দর্শন করতে পারব, এখনত শুনছি বাসও বন্ধ। সাধুবাবা আমার দিকে বেশ কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলেন, তারপর বললেন, কেন পারবি না, মনে যদি দর্শনের বাসনা তীব্র থাকে তবে তীর্থের দেবতা নিজেই যে তোকে কাছে টেনে নেবেন। সারাদিন তো তোদের বাসেই কেটে গেছে, খাওয়া দাওয়াও তো ঠিক মতন হয়নি, নে এই প্রসাদ টুকু খেয়েনে। বলেই সাধুবাবা তাঁর ঝোলা থেকে অনেকগুলি আপেল বের করে আমায় দিলেন। আমরাও সানন্দে সেই আপেলগুলি খেতে লাগলাম। অত্যন্ত সুমিষ্ট আপেল, এক কামড় দিতেই কষ বেয়ে রস গড়িয়ে পড়ল। খাওয়া শেষ হলে সাধুবাবা’কে পুনরায় প্রনাম করে বিদায় নেবার সময় জিজ্ঞাসা করলাম বাবা এবার আপনি কোথায় যাবেন?সাধুবাবা উত্তর দিলেন এখন আমি হরিদ্বারে নেমে যাব, ওখানে ব্রহ্মকুণ্ডে স্নান করে চলে যাব কেরলের শবরীমালা দর্শনে, ওখানেই আপাতত কিছুদিন থাকব।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *