প্রয়াত বিদ্যাসাগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন উপাচার্য ডঃ আনন্দদেব মুখোপাধ্যায়, স্মৃতিচারণা করলেন উদ্ভিদ বিজ্ঞানী ডঃ অমল কুমার মন্ডল

জে মাহাতো, আমাদের ভারত, মেদিনীপুর, ৮ অক্টোবর:
একজন প্রকৃত শিক্ষাবিদ, প্রকৃত পরিবেশবিদ, প্রকৃত মানুষকে আজ হারালাম। বিদ্যাসাগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন উপাচার্য অধ্যাপক আনন্দদেব মুখোপাধ্যায় ২১-১০-১৯৯ থেকে ৩০-১১-২০০৩ পর্যন্ত উপাচার্যের গুরু দায়িত্ব সামলেছেন। একাধারে তিনি ছিলেন দিঘা-শঙ্করপুর উন্নয়ণ পর্ষদের চ্যায়ারম্যান। যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূ-তত্ব বিষয়ের স্বনামধন্য অধ্যাপক। নিজের হাতে দিঘা-শঙ্করপুর উন্নয়নের মাস্টার প্যান তৈরী করেছিলেন, শুধু তৈরী করা নয় তার কি করে সঠিক প্রয়োগ করা যায় সেটাই ছিল তাঁর একমাত্র ধ্যানজ্ঞান। করেও দেখিয়েছিলেন। সৎ ইছা থাকলে, বিষয়ের প্রতি জ্ঞান থাকলে অনেক কিছুই করা যায়।

প্রাকৃতিক ভাবে বেড়ে ওঠা সমুদ্রের পাড়ে যে সমস্ত উদ্ভিদ রয়েছে সেই সব উদ্ভিদের এ্যান্থ্রোপ্রোজেনিক এক্টিভিটি থেকে কীভাবে বাঁচিয়ে রাখা যায় এবং অন্য দিকে বোল্ডার ফেলে, কাঠের গুঁড়ি ফেলে কি ভাবে সমুদ্রের ভাঙ্গন রোখা যায় সেই চেষ্ঠা তিনি করে গেছেন। আসলে উনি জানতেন সমুদ্রের এই ক্ষয়কে যদি রোখা না যায় তাহলে পূর্ব মেদিনীপুরের বিস্তীর্ণ অঞ্চল সমুদ্র গর্ভে চলে যাবে। মানুষের দ্বারা প্রকৃতি নিধনের যে কর্মযজ্ঞ চলেছে তারজন্য তিনি কষ্ট পেতেন, যন্ত্রণা অনুভব করতেন। আমি সরাসরি উনাকে আমার বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য হিসাবে পাইনি কারণ আমি বিদ্যাসাগর বিশ্ববিদ্যালয়ে ২৬ সেপ্টম্বর, ২০০৬ সালে বারাসাত সরকারি মহাবিদ্যালয় থেকে এসে যোগদান করি। কিন্তু আমার বিশ্ববিদ্যালয়ের সহকর্মীদের কাছে সব সময় তাঁর সম্পর্কে অনেক কথা শুনেছি, কত বড় মানুষ ছিলেন, অধ্যাপকদের কত সম্মান করতেন, কতটা ভালোবাসতেন। একটা ঘটনার কথা উল্লেখ করতে চাই, এই অল্প পরিসরে, একবার একটি পরীক্ষার খাতা একজন অধ্যাপক জমা দিতে দেরি করেছিলেন। সেটা জানতে পেরে নিজের টেলিফোন তুলে উনি সেই অধ্যাপককে অনুরোধ করে বললেন, আপনি পরীক্ষার খাতাটা একটু তাড়াতাড়ি জমা করে দিন, রেজাল্টটা বের করতে হবে তো? কাজ হয়ে গেল। তার পর দিন খাতা জমা পড়ে গেল। এই হচ্ছেন অধ্যাপক আনন্দদেব মুখোপাধ্যায়। কঠিন বিষয়কে কি ভাবে সহজ করা যায়, উনার কাছ থেকে শিখতে হবে।

আমি যখন দিঘা-শঙ্করপুর নিয়ে ন্যাচারাল সয়েল বাইন্ডার প্ল্যান্টস যেমন আইপোমিয়া বাইলোবা (আইপোমিয়া পেসকাপ্রি), স্পিনিফেক্স স্কোয়ামসা, প্যান্ডানাস, ক্যাসুরিনা, প্রসোপিস ইত্যাদি নিয়ে গবেষাণা শুরু করলাম তখন উনি আমাকে নানাভাবে সহযোগিতা করেছেন, উনার সহযোগিতার কথা কোনও দিন ভুলবো না। আমি আমার রিসার্চটিম নিয়ে বার বার গিয়েছি উনার কাছে, বার বার উনার গবেষণার বিষয় আমাকে টেনে নিয়ে গেছে উনার সান্নিধ্যে। বলতেন, অমল খুব ভাল করে মন দিয়ে এই কাজটা করো। আজ উনি চলে গেছেন কিন্তু কানে সব সময় উনার কথাগুলো বাজে। এই দিঘার উপর আমার কাছে পাঁচ ছয় জন গবেষণার কাজ করে চলেছে, কিন্তু কাজের রেফারেন্স ছাড়া দিঘা-শঙ্করপুরের কাজ অসমাপ্ত থেকে যাবে। বিভিন্ন রাজনৈতিক থেকে সামাজিক, পরিবেশ নিয়ে প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক মিডিয়ার তাঁর বক্তব্যে খুব স্পষ্ট বার্তা থাকতো। আজ কোভিড-১৯ এর জন্য উনাকে আমরা হারালাম, শিক্ষা জগতের অপূরণীয় ক্ষতি হল। একজন মানুষ এবং একজন অধ্যাপক হিসাবে উনার কাছে থেকে অনেক কিছু শেখার ছিল। যে কোনও বিষয় তা সেটা গবেষণা হোক বা অন্য কিছু সব সময় পজেটিভ। না জানি এই অতিমারীর জন্য আর কতো মনিমুক্তো হারাবো। যেখানেই থাকুন ভালো থাকুন, সুস্থ থাকুন, আপনি থাকবেন প্রকৃত সকল শিক্ষাবিদের মনের অন্তরে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *