ড. রাজলক্ষ্মী বসু
আমাদের ভারত, ২৮ মে: অটলবিহারী বাজপেয়ীর সেই আবেগঘন বক্তব্য আজ সাভারকার জন্মজয়ন্তীতে সোস্যাল মিডিয়ায় ঘোরাঘুরি করছে- “সাভারকার মানে তেজ, সাভারকার মানে ত্যাগ, … সাভারকার মানে তারুণ্য, সাভারকার মানে তর্ক, সাভারকার মানে তীর, সাভারকার মানে তরোয়াল, তিলমিলাহট, …সাভারকার মানে তিতিক্ষা …।” তিনি বলেছিলেন, কবিতা আর ক্রান্তির মিলন সাভারকার। এও বলেছিলেন কবিতা আর ভ্রান্তি একসাথে চলে, কিন্তু ক্রান্তি! ঠিকই ভ্রান্তি বারে বারে আমাদের ইতিহাস করেছে।
সাভারকারের পূর্ণ মর্যাদা এবং তাঁর গরিমাকে দেশ অনেকটাই পরে জেনেছে, বা এখনো অনেকে জানেনইনি। জানতে দেওয়া হয়নি। ভারতের স্বাধীনতার রূপনায়কদের মধ্যে সাভারকার অন্যতম। আজ তাঁর জন্ম তিথিতে এ আমাদের কর্তব্য তাঁর কীর্তিকে ভ্রান্তির মেঘ থেকে মেলে ধরা। Think globally act locally র পথপ্রদর্শক সাভারকার। লেখা পাগল ঐ বীরের প্রকাশিত প্রথম সাক্ষ্য বহন করে ফার্গুশান কলেজের “সপ্তপদী” আর্টিকেল, যা Aryan weekly তে প্রকাশের পর সবার মনে সাভারকার নামটি ছুঁয়ে যায়।
ঐতিহাসিকদের একাংশ বলেন, সাভারকার বাল গঙ্গাধর তিলক দ্বারা প্রভাবিত হয়েছিলেন। স্বদেশী নীতি ও লড়াইয়ে দেশের যে সংগ্রামী প্রথম কলেজ থেকে বহিষ্কৃত হন তিনি আর কেউই নন, সাভারকার। ১৯০৫ এর নভেম্বরে বিদেশী কাপড় বর্জন ও পুড়িয়ে দিলে তাঁকে ১০ টাকা জরিমানা এবং এক্সপেল্ড হতে হয়। সেদিন দক্ষিণ আফ্রিকায় মোহন দাস করমচাঁদ গান্ধী এর নিন্দা করেন, এ বুঝি হিংসার প্রতীক। তারপর ১৯০৮ , তিনিই এই পন্হা অবলম্বন করে জোহানেসবার্গের হামিদিয়া মসজিদে অন্ততপক্ষে ২০ হাজার রেজিস্টার সার্টিফিকেট জ্বালিয়ে দেন। ১৯০৬ সালে বিনায়ক দামোদর সাভারকার শিবাজী স্কলারশিপে লন্ডনের গ্রে’স ইন ল কলেজে পঠন পাঠনে গেলে এক নতুন মোড়ের সম্মুখীন হন।
লন্ডনের ইন্ডিয়ান হাউজে থাকাকালীন তিনি ইতালির মাজিনির জীবন ও দর্শন মারাঠাতে অনুবাদ করেন। কেমন করে ইংরেজদের কবল থেকে ঐ ইতালির বীর স্বাজাত্যবোধের দ্বারা সঙ্ঘবদ্ধ শক্তিতে দেশ স্বাধীন করলেন সে বিবরননামা দামোদর সাভারকারের দাদা বাবুরাও সাভারকার কর্তৃক এ দেশে প্রকাশ করলে তার গভীর প্রভাব এ দেশের স্বাধীনতা সংগ্রামীদের উপর। দলে দলে তরুণ উদ্বুদ্ধ হন। ১৯০৯ এর প্রেস অ্যাক্ট দ্বারা যদি ব্রিটিশরা প্রথম কোনো বইতে কাঁটাতার দেয় তাহলে তা ওটিই।
বামমনোভাবাপন্ন বহু ঐতিহাসিক সাভারকারের এই কর্মপদ্ধতির ব্যাখ্যায় বলেছিলেন, তিনি বুঝি ফ্যাসিস্ট এবং পশ্চিম সভ্যতা দ্বারা প্রভাবিত। প্রসঙ্গক্রমে বলি, স্বয়ং জওহরলাল নেহেরুই ইতালির গ্যারিবিল্ড এবং মাজিনি দ্বারা প্রভাবিত ছিলেন। গান্ধীর কর্ম ধরনের ব্যাখ্যায় সে সময়ের ঐতিহাসিকই বলেছেন, “Mazzini’s young Europe of 1834 and his young Italy also inspired Gandhi to start young India movement।”
সাভারকার ছিলের ঝর্ণার মতো চঞ্চল। সমুদ্রের মতো গভীর। তিনি অদম্য। আবার চলল কলম। সিপাহী বিদ্রোহে কেমন করে ইংরেজরা জিতল, কেমন করে সে ষড়যন্ত্র তারা আঁটল তার গোপন দলিল সংকলন রচনা করেন, যা ১৯০৮ এর এপ্রিলে The Indian war of Independence: 1857 নামে পরিচিত। কলম থামল আর দেশেদ্রাহীর তকমা পড়ল। বিশ্বে সম্ভবতঃ এটিই মুদ্রিত প্রথম বই যা প্রকাশের পূর্বেই কারাবাসে যায়। সাহস যেখানে, ইচ্ছেও সেখানে। হ-ল্যান্ড থেকে সেই বই প্রকাশিত হয়। আমেরিকা, জাপান, চীন, ভারতসহ বিভিন্ন দেশে ছদ্ম বই মলাটে তা ছড়িয়ে যায়। এমনকি ফরাসী বিপ্লবীরা তা অনুবাদও করেন। ভগত সিং এই বইকেই বলেছিলেন, “Gita of ড়েভলুতিওনারিএস,” স্বয়ং সুভাষ বসুও এই বই থেকেই আদর্শ অনুপ্রেরণা সঞ্চয় করেন।
ইতিহাস আমাদের জানতে দেয়নি সেই ইতিহাস- স্বাধীন ত্রিরঙ্গা প্রথম সাভারকারই ওড়ান। ১৯০৭, আগস্ট, জার্মানিতে International Socialist Congress এ অনেক প্রতিকূলতার মধ্যে সেদিন ভারতের পতাকা গর্বিত ভাবে উন্মীলিত হয়। সব দেশের আমন্ত্রিত সদস্য তা স্যালুট করেন। ১৯৯৯ জানুয়ারি কেশরী ওয়াদা মিউজিয়ামের (পতাকাটি সংরক্ষতি) উদ্বোধন করেন সোনিয়া গান্ধী– যারাই কিনা তাঁকে গদ্দার আখ্যা দেয়।
মার্চ ২০১৬ পার্লামেন্টে রাহুল গান্ধী বলেছিলেন, “We have Gandhi you have Savarkar।” ওঁনারা নির্ঘাত ইন্দিরা গান্ধীর ১৯৮০ তে লেখা সেই চিঠির কথা বেমালুম ভুলে গেছেন- “Veer Savarkar’s daring defience of the British Government has it’s own important place in the annals of our freedom movement।” আসামীর কাঠগড়ায় বারে বারে এসেছে বীর সাভারকারের নাম। আন্দামান জেল আর তার মার্সি পিটিশন নিয়ে। আবারও বিকৃত ইতিহাস আমরা জানিনি, জানতে দেওয়া হয়নি আসল সত্য। লন্ডনের ইন্ডিয়ান হাউজের উপর তখন কড়া নজর, কারণ সেই সাভারকার। ইতিমধ্যেই তাঁর দাদা বাবুরাও সাভারকার আন্দামান জেলে নানান অত্যাচারের সম্মুখীন। সাভারকারের নেতৃত্বে জোরকদমে চলছে লর্ড মিন্টোকে হত্যার পরিকল্পনা। নাসিকের কালেকটার জ্যাকশনের প্রাণটি যেই তরুণ বিপ্লবীদের হাতে গেল অমনি দু’ য়ে দু’য়ে চার করে শেতাঙ্গ পুলিশ আদাজল খেয়ে সাহেব হত্যা আর সাভারকার যোগসূত্র প্রমানের চেষ্টা করে। সফলও হয়। তৎকালীন বোম্বের গভর্নর জর্জ ক্লার্ক এই নওজোয়ান ক্ষুরধার বুদ্ধির অধিকারী একহাতে পিস্তল তো অন্য হাতে কবিতা আর প্রবন্ধের কলমধারী সব্যসাচীকে Most dangerous men India had ever produced বলে চিহ্নিত করে।
১৮৮১ র ফিউজিটিভ অফেনডার অ্যাক্ট অনুযায়ী তাঁর নামে ওয়ারেন্ট বের হয়। ছদ্মবেশে সাভারকার প্যারিসমুখী হন। কিন্তু লন্ডনের ভিক্টোরিয়া স্টেশনে সেই most dangerous man পুলিশের কবলে পড়েন, আবারও তিনি জাহাজ থেকে উধাও। শেষ রক্ষা যদিও হয়নি। এবং তাও অন্য সহচরদের পরিকল্পনায় সামান্য ফাঁক বা বলা ভালো সে সময়ের অপরিণত যোগাযোগ মাধ্যমের জন্য। মাত্র আঠাশ বছরের তরুণ সাভারকারের ট্রায়াল চলে পুনের ওয়ারধার সেন্ট্রাল জেলে থাকাকালীন। ৪ঠা জুলাই ১৯১১ পঞ্চাশ বছরের অমানবিক পাশবিক সশ্রম কারাদণ্ডে তিনি আন্দামানে দ্বীপান্তরে যান। নরক যন্ত্রণায় প্রতিদিন তাঁর শেষ রক্ত বিন্দু শোষণ করত জেলার। Savarkar and his times বইতে সে নিদারুণ ছবি চোখে জল আনবে। সেলুলার জেলের জেলার বেরি সাহেব সাভারকারকে রাজনৈতিক বন্দীর মতো দেখেনি। জঘন্য ক্রিমিনালের দৃষ্টিতে পাশবিক আচরণ চলে। শৌচালয়ের সুবিধা টুকুও তিনি পাননি। সাভারকারের রচিত My Transportation for Life জেলের নিষ্ঠুর সত্য যা ইতিহাসে লুকানো তাঁর দলিল। আন্দামান জেলে তাঁর বুকে “D” ( for Dangerous) লেখা থাকত। যা প্রত্যেকদিন অত্যাচার বাড়াতো।
তখন প্রথম বিশ্ব যুদ্ধের দামামা বাজে। সাভারকার আন্দাজ করেছিলেন ব্রিটিশদের উপর চাপ সৃষ্টির এই তো সুবর্ণ সুযোগ। তিনি লাগাতার দরখাস্ত করেন জেলের কুব্যবস্হার বিরুদ্ধে। তাঁর হাতের কলম টুকুও কেড়ে নেওয়া হয়। দশ দশটি বছর প্রতিনিয়ত নরক যন্ত্রণা ভোগের পর প্রথম বিশ্ব যুদ্ধ শেষের পর তিনি রাজনৈতিক প্রয়োজনীয়তার খাতিরে ব্রিটিশের লেখা কাগজে মুচলেকা দিয়ে আন্দামান জেল থেকে রত্নগিরি জেল তারপর শর্ত মুক্তি। শর্ত ছিল কোনো ভাবেই তিনি যদি স্বাধীনতা সংগ্রামে চোখে পড়েন আবার সেলুলার জেল হবে তাঁর পাকা ঠিকানা। ছদ্মনামে তিনি কাজ করতেন তখন।
নেহেরুর কারাগার জীবন একটু দেখে নেওয়া যাক। স্বয়ং আসফ আলি তাঁর বর্ণনায় লিখেছেন — জেলের কক্ষে থাকত তাঁর প্রিয় নীল রঙের পর্দা। সশ্রম কারাদণ্ডে তিনি গোলাপ বাগান করেছেন। তিনি বই লিখেছেন। ছিল সব সংবাদপত্র আর সরঞ্জামের জোগান। স্ত্রী অসুস্থ হলে তিনি ছুটিও পান। সাভারকারের লেখার খাতা ছিল এক ফালি অন্ধ কুঠুরির দেওয়াল। পাশবিক অত্যাচার আর সশ্রম কারাদণ্ডে ছিল হাত দিয়ে নারকেল ছাড়ানো। দু হাতে পাষান আর রক্ত এই ছিল তাঁর জেল কথা। রাসবিহারী বসু এই বীরকে যথার্থ সম্মান দেন। রেডিও ব্রডকাস্টিং এ উনি বলেন, ” In saluting you I have the joy of doing my duty towards one of my elderly comaredes in arms . In saluting you I am saluting the symbol of sacrifice itself।”
তাঁর জন্মজয়ন্তীতে আমাদের সবার স্যালুট করার সময় এসেছে। রাজনৈতিক মত ভিন্ন হতেই পারে কিন্তু ইতিহাসের সত্য রূপ উন্মোচিত হোক। স্বয়ং প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি আবদুল কালামও কিন্তু সাভারকারের বিকৃত ইতিহাসের সমর্থন করেননি। আমরা যেন আর আংশিক বলা আর আংশিক মিথ্যে ইতিহাসে পথভ্রষ্ট না হই।