অশোক সেনগুপ্ত, আমাদের ভারত, ১৬ ডিসেম্বর: নয়া শিক্ষানীতি রূপায়ণে স্থানীয় ভাষাকেও পরিসর দেওয়ার প্রয়োজনীয়তা আছে। শুক্রবার এক সর্বভারতীয় আলোচনায় স্বাগত ভাষণে এই মন্তব্য করেন কলকাতার বাবা সাহেব অম্বেদকর এডুকেশন ইউনিভার্সিটির (বিএসএইইউ, পূর্বতন দি ওয়েস্ট বেঙ্গল ইউনিভার্সিটি অফ টিচার্স ট্রেনিং, এডুকেশন, প্ল্যানিং অ্যান্ড অ্যাডমিনিষ্ট্রেশন) এবং ডায়মন্ডহারবার মহিলা বিশ্ববিদ্যায়ের উপাচার্য, বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ অধ্যাপক ডঃ সোমা বন্দ্যোপাধ্যায়।
বিএসএইইউ-এর ডেভিড হেয়ার ক্যাম্পাসে আয়োজিত অনুষ্ঠানে তিনি বলেন, এই শিক্ষানীতির রূপায়ণে হিন্দিকে দেশের মূল ভাষার মর্যাদা দিয়ে প্রাদেশিক ভাষাগুলোকে মর্যাদা দিলে সব ভাষারই উন্নতি হবে। প্রতিটি রাজ্য নয়া শিক্ষানীতির রূপায়ণে উদ্যোগী হলে সামগ্রিক সুফল মিলবে। এই প্রথম ‘কেন্দ্রীয় হিন্দি সংস্থান’ পশ্চিমবঙ্গের কোনও বিশ্ববিদ্যায়ের সঙ্গে এভাবে যৌথ আলোচনার আয়োজন করেছে।
ডঃ সোমা বলেন, কীভাবে, কতটা শিক্ষানীতির পরিবর্তন প্রয়োজন, নয়া জাতীয় শিক্ষানীতির রূপায়ণে এ সবই বিবেচনা হয়েছে। স্বামী বিবেকানন্দ বলেছিলেন শিক্ষায় সম্পূর্ণতা আসে। গান্ধীজী শিক্ষায় আত্মনির্ভরতা ও শাশ্বতাকে গুরুত্ব দিয়েছিলেন। বঙ্কিমচন্দ্র থেকে রবীন্দ্রনাথ গুরুত্ব দিয়েছিলেন শিক্ষাভাবনাকে।
সোমা দেবী বলেন, “নয়া শিক্ষানীতিতে ৩ থেকে ১৮ বছর বয়সীদের ৫+৩+৩+৪ বছর ধাঁচে পড়ানোর ব্যবস্থা হয়েছে। মাল্টিপিল এন্ট্রি-এক্সিট পদ্ধতি অনুসরণ করায় ৬ মাস বাদে কেউ পড়া ছেড়ে দিতে বাধ্য হলেও তিনি শংসাপত্র পাবেন। অ্যাকাডেমিক ক্রেডিট ব্যাঙ্কের সুবিধা থাকবে। ইউজিসি, এআইসিটিই-র মত বিভিন্ন স্তরের সংস্থার কাঠামো বদলে ভারতীয় উচ্চশিক্ষা পরিষদ তৈরি হবে।
অতিমারিতে সব বন্ধ হয়ে গেলেও পড়াশোনা বন্ধ হয়নি। অনলাইন চালু হয়েছে। ‘ব্লেন্ডেড মোড’ চালু হয়েছে। এসবের অভিজ্ঞতা নিয়ে ডিজিটাল এডুকেশন, ন্যাশনাল এডুকেশন টেকনোলজি ফোরাম হচ্ছে। কোনও বিশ্ববিদ্যালয়ের মূল পরিচয় হচ্ছে গবেষনা। গবেষনার ওপর জোর দেওয়া হচ্ছে নয়া শিক্ষানীতিতে। পিএইচডি-র গবেষকরা পড়াবেন স্নাতকদের। এতে পড়ুয়াদের মধ্যে উচ্চশিক্ষার বাসনা আরও তীব্র হবে।”
প্রধান অতিথির ভাষণে কেন্দ্রীয় হিন্দি শিক্ষণ মণ্ডলের সহ-সভাপতি ডঃ অনিল শর্মা জোশী বলেন, পলাশির যুদ্ধের পর থেকে ১৯১১ সালে ভারতের রাজধানী স্থানান্তর পর্যন্ত বরাবর শিক্ষা-সংস্কৃতি-স্বাধীনতা সংগ্রাম— প্রতিটি ক্ষেত্রে পথ দেখিয়েছে বাংলা। স্বামী বিবেকানন্দ, ঋষি অরবিন্দ, সুভাষচন্দ্র, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর—এঁরা দেশের অস্মিতা, স্বাভিমানের পথ দেখিয়েছেন। নেতৃত্ব দিয়েছেন। নয়া শিক্ষানীতি প্রণয়ণে এঁদের ভাবনার যথাযোগ্য মর্যাদা দিতে হবে।
অনিলবাবু বলেন, দেশ স্বাধীন হওয়ার আগে নোবেল জয় করেছিলেন রবীন্দ্রনাথ। দেশের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ছিল শান্তিনিকেতন। পন্ডিত নেহরু তাঁর কন্যাকে এখানেই পড়িয়েছিলেন। ভারত এবং প্রতিবেশী দেশের রাষ্ট্রগানের জন্ম এই বাংলায়। রবীন্দ্রসঙ্গীতের জন্ম এখানে। দেশের সংবাদপত্রে কলকাতা ছিল পথপ্রদর্শক। বলিউডেও সাফল্য দেখিয়েছে বাংলা। ২০০৩-এ বিশ্ব বইমেলায় ব্রিটেনে আমন্ত্রিত ছিলাম। সেখানে ন্যাশনাল বুক ট্রাস্টের অনুষ্ঠানে নোবেলজয়ী অমর্ত্য সেন বলেছিলেন, কলকাতা হল বইমেলার আদর্শ স্থান। যে বাংলা ঐতিহ্য-সংস্কৃতি এত উর্বর, এত ঘটনাবহুল, সেই বাংলা শরিক হোক নয়া শিক্ষানীতিতে।
ডঃ অনিল শর্মা জোশী বলেন, প্রতি ক্ষেত্রে সমকালীনতা একটা বিচার্য বিষয়। ১৯৮৬-তে হয়েছিল শেষ শিক্ষানীতি। ৩৪ বছর বাদে নয়া শিক্ষানীতির একটা আবশ্যিকতা রয়েছে। প্রতি বছর ১৮ লক্ষ পড়ুয়া ইঞ্জিনিয়ারিং পাঠ্যক্রমে ভর্তি হয়। ১৩ লক্ষ পাশ করেন। ৫ লক্ষ হারিয়ে যান। এর অন্যতম প্রধান কারণ বিদেশি ভাষা। সেই ১৯১৮-তে মহাত্মা গান্ধী ইন্দোরে বলেছিলেন দেশে একটা ভাষা হওয়া দরকার। হিন্দিকে প্রাধান্য দেওয়ার কথা বলেছিলেন তিনি। ইংরেজিতে আমরা বড় বেশি আসক্ত হয়ে পড়েছি। সমাজের মানসিকতা এমন হয়ে গিয়েছে যে অভাভাবকরা ভাবেন শিশু ইংরেজি না শিখলে কী হবে? কেবল ইংরেজি যদি প্রতিভাধরদের ভাষা হত, ইংরেজরা বিশ্ব শাসন করত। যেখানে আবশ্যিক, সেখানে ইংরেজি থাকুক! দক্ষিণ ভারতের চারটি ভাষাকে শাস্ত্রীয় ভাষার মর্যাদা দেওয়া হয়েছে। ভারতের বিভিন্ন রাজ্যে ভারতীয় ভাষায় পঠনপাঠন শুরু হয়েছে। নয়া শিক্ষানীতিতে জোর দেওয়া হচ্ছে এই নিজস্ব ভাষার ওপর।
দীক্ষান্ত ভাষণে আগ্রার কেন্দ্রীয় হিন্দি সংস্থান পরিচালক, বিশিষ্ট বক্তা, লেখক ও অধ্যাপক ডঃ বীনা শর্মা বলেন, কোন উদ্দেশ্যে, কাদের জন্য নয়া শিক্ষানীতি করা হচ্ছে, তা অনুধাবন করতে হবে। মাতৃভাষাকেও বাঁচাতে হবে। ভাষা মানুষের মধ্যে সেতু তৈরি করে। স্বদেশে পূজ্যতে রাজা, বিদ্বান সর্বত্র পূজ্যতে— কোন শিক্ষা, কোন বিদ্যা এসব মাথায় রাখা দরকার। শিক্ষাকে আবেগ করতে হবে। মনোবিজ্ঞান ও আচারের সূচিতার ওপর গুরুত্ব দিতে হবে। ভারতীয় সংস্কৃতিকে আত্মস্থ করতে পারলে দেশ নির্মাণে বড় ভূমিকা নিতে পারবেন।
কেন্দ্রীয় হিন্দি সংস্থানের অধিকর্তা ডঃ রঞ্জন কুমার দাশ বলেন, নয়া শিক্ষানীতি আমাদের নিছক পছন্দের বিষয় (চয়েস) নয়, এটা ছিল একটা আবশ্যিক (নেসেসিটি)। আলোচনাচক্রের সংগাঠনিক সম্পাদক অধ্যাপক ডঃ মৃণাল মুখার্জি বলেন, অন্ধজনে দেহ আলো মৃতজনে দেহ প্রাণ। দেশে অর্জুনের অভাব নেই। কিন্তু দ্রোনাচার্যের প্রয়োজন আছে। নয়া শিক্ষানীতিতে অন্তসলিলাফল্গুর মত রয়েছে ভারতের অন্তর্নিহিত ভাবনা, আধ্যাত্মিকতার শক্তি। উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে সমাপ্তি ভাষণে সংক্ষেপে নয়া শিক্ষানীতির গুরুত্ব এবংউপস্থিতদের অভিনন্দন জানান বাবা সাহেব অম্বেদকর এডুকেশন ইউনিভার্সিটির রেজিস্ট্রার ডঃ কুণাল কান্তি ঝা।
নয়া শিক্ষানীতি বিষয়ে প্লেনারি সেশনে সভাপতিত্ব করেন ডঃ বীণা শর্মা। এ ছাড়া ছিলেন শান্তিনিকেতনের ডঃ বেনুধর চিনারা ও দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক যুক্তি শর্মা। দুটি টেকনিক্যাল সেশনে ছিলেন ডঃ রঞ্জন কুমার দাশ বিএসএইইউ-এর প্রধান ডঃ বিশ্বজিৎ বালা, রবীন্দ্র ভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের হিন্দি বিভাগের অধ্যাপক ডঃ প্রতীক সিং এবং বিএসএইইউ-এর ডঃ অবন্তিকা মণ্ডল। সন্ধ্যায় পরিবেশিত হয় সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান।