অরিত্র ঘোষ দস্তিদার এবং ড. কল্যাণ চক্রবর্তী, আমাদের ভারত, ২৯ আগস্ট: আজকাল ‘অজগর ফল’-এর নাম শোনা যায়। হ্যাঁ, ওরই নাম ‘ড্রাগন ফ্রুট’। চৈনিক লোকসংস্কৃতিতে এবং পূর্ব এশিয়ায় ‘ড্রাগন’ বলতে এক কল্পিত সরীসৃপ বোঝায়। অনেকটা ডাইনোসর বা ‘ডানাসুর’-এর মতো। অনেকটা পেল্লায় অজগর সাপ যেন! তার মুখ থেকে বেরোচ্ছে আগুন!
ড্রাগন ফ্রুট গাছের পর্ণকাণ্ডও যেন সাপের লতানো অবয়ব। তারই গায়ে গায়ে, আগার কাছে পাকা লাল ফলগুলি যেন অজগর সাপেরই মুণ্ড! অথবা ড্রাগনের অগ্নি নির্গমনের লালাভ সংকেত। সেই জন্যই বুঝি বাংলার লোকসমাজে ফলের স্থানীয় নাম হয়ে গেলো ‘অজগর ফল’।
এই ফলের এখন দারুণ চাহিদা। চাষীরা বাড়িতে একটা ‘অজগর ঢিপি’ বা ড্রাগন গ্রুভ তো রাখতেই চান। শহুরে বাগানবিলাসীরাও ছাদে বড় টবে চাষ করতে চাইছেন।
উদ্ভিদবিদ্যাগত পরিচিতি
অজগর ফল বা ড্রাগন ফলের উদ্ভিদবিদ্যাগতনাম হাইলোসিরিয়াস কোষ্টারিসেনসিস। এটি একধরনের ক্যকটাস গাছ, লতানে কাঁটাওয়ালা তার দৈহিক গড়ন। লতাকে সাপোর্ট দিয়ে উঁচিয়ে, তারপর ঝুলিয়ে দেবার বন্দোবস্ত বা কায়াদান করলে (Training) যে শ্রীময়ী বা অর্নামেন্টাল গাছ হয়ে ওঠে, তা একপ্রকার অনবদ্য গার্ডেন-ফিচার। তার শোভা তো আর কেবল গাঢ়/হাল্কা সবুজের পর্ণকাণ্ড নয়, শোভার মধ্যে তার পাকা ফলটিও রয়েছে, যা সবুজ থেকে ধীরে ধীরে রঙ ধরে। গাছের শোভা তার বৃহৎ সাদা ফুলেও, যা রাতের অন্ধকারে ফোটে, প্রভাতের আলো বাড়লে ক্রমশ গুটিয়ে যায়। এই ফুলের শোভা অসাধারণ। রাতের পার্টিতে যাতায়াতের পথ থেকে একটু দূরে পরপর বড় টবে সাজিয়ে রেখে, খুঁটিতে বেঁধে দিলেও তার কাণ্ড, ফুল, ফলের শোভা দেখতে পান রাতের অতিথিরা।
ড্রাগন ফ্রুট পেরেনিয়াল প্ল্যান্ট বা বহুবর্ষজীবী উদ্ভিদ। লতানো গাছ, আগেই বলেছি। এই লতানে কাণ্ডল অংশ বা পর্ণকাণ্ড, যা আদতে সবুজ বর্ণের। এগুলি পাতার কাজটিই করে দেয়। লতার কাণ্ডটি হয় তেকোণা, তবে চারকোণা হওয়ার সম্ভাবনাও থাকে বলে জানা গেছে৷ সবচেয়ে বড় বৈশিষ্ট্য হল, এই লতানে কাণ্ড ডগমগে যৌবন নিয়ে বেশ দ্রুত বেড়ে যায়। কাণ্ডের ভেতরটা যদি কেটে দেখা যায়, তবে তার মধ্যে শাঁসালো বস্তু বেশ ভালোভাবেই বোঝা যাবে। বুঝতে অসুবিধা হয় না, এমন একটি ফণীমনসা জাতীয় মরু অঞ্চলের গাছের স্বাভাবিক প্রবণতা হবে মহার্ঘ জল যতটা সম্ভব নিজের দেহের অভ্যন্তরে জমিয়ে রাখা এবং প্রতিকূল পরিবেশের সঙ্গে লড়াই করে টিকে থাকা।
পাতার স্বাভাবিক প্রবণতা হল, তারা বাষ্পমোচন প্রক্রিয়ায় দেহের জল বাষ্পীভূত করে দেয়। মরু অঞ্চলেও যদি পাতার এই বৈশিষ্ট্য অকৃত্রিম থাকে তো গেল! তাই গাছ অভিযোজনের মাধ্যমে তার পাতাটাই সঙ্কুচিত করে দিতে চেয়েছে। পাতা ক্রমাগত ছোটো হতে হতে কাঁটায় পর্যবসিত হয়েছে। তাহলে পাতার কাজ করছে কে? করছে তার সবুজ কাণ্ড, ডালপালা, সেখানেও যে সবুজ ক্লোরোফিলের অফুরন্ত ভাণ্ডার। সারা কাণ্ড দিয়েই তাই সালোকসংশ্লেষের কাজ চলে। এজন্যই এদের কাণ্ডকে বলা হয় ‘পর্ণকাণ্ড’।
পুষ্টিগুণ এবং উপযোগিতা
প্রশ্ন হচ্ছে, অজগর ফল কেন খাবো? এই ফলের গুণাগুণগুলিই–বা কী? বিজ্ঞানীরা বলছেন, ড্রাগন ফ্রুট ভিটামিন ও খনিজ লবণের গুরুত্বপূর্ণ আধার। তাতে প্রোটিন, ফ্যাটও গ্রহণযোগ্য মাত্রায় রয়েছে, রয়েছে অ্যান্টি অক্সিডেন্ট। জানা গেছে, এই ফলের মধুমেহ বা ডায়াবেটিস রোগ নিয়ন্ত্রণের ক্ষমতা আছে, ক্ষমতা রয়েছে রক্তে কোলেস্টেরলের মাত্রা কমানোর। হৃদপিণ্ডের সদর্থক সচলতায় এই ফলের ভূমিকা প্রশংসনীয়। নিয়মিত এই ফল গ্রহণ করলে বার্ধক্য দেরিতে আসে বলে জানা গেছে। বাত প্রতিরোধে এবং হাঁপানি দূর করতে এই ফলের ভূমিকাও আশাব্যঞ্জক। যারা শারীরিক ওজনকে একটি নির্দিষ্ট সীমায় বাঁধতে চান, তারাও এই ফল নিয়মিত গ্রহণ করে উপকৃত হয়েছেন৷
বিশ্বব্যাপী ড্রাগন ফলের বাণিজ্য
প্রথমে জেনে নিই, ড্রাগন ফলের বিশ্বব্যাপী যোগানদার কারা। মূলত তিনটি উৎপাদন অঞ্চল রয়েছে ড্রাগন ফলের।
১. এশিয়ার মধ্যে ভিয়েতনাম, চীন, থাইল্যান্ড, তাইওয়ান, ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়া, ফিলিপিন্স, কম্বোডিয়া, ভারত এবং শ্রীলঙ্কা।
২. মধ্য এশিয়া ও ইউরোপের ইসরায়েল, সুইজারল্যান্ড এবং ইউরোপীয় ইউনিয়ন।
৩. আমেরিকার মেক্সিকো, কলম্বিয়া, ইকুয়েডর, গুয়াতেমালা এবং কোস্টারিকা।
পৃথিবীর মধ্যে সবচাইতে বেশী ড্রাগন ফ্রুটের যোগান দেয় ভিয়েতনাম। ভিয়েতনামী ড্রাগন ফলের ট্রেডমার্ক দীর্ঘদিনের। ভিয়েতনামী বাজার এশিয়ায় এবং আমেরিকায় বেশ ভালো। চীনের বাজার মূলত ভিয়েতনাম দখল করে আছে৷ দখল করার চেষ্টা করছে হংকং, তাইওয়ান, থাইল্যান্ড এবং মালয়েশিয়ায় বাজারও।
ভিয়েতনামী লাল ড্রাগন ফ্রুটের সাইজ অন্য টাইপগুলির তুলনায় বেশ বড় এবং দৃষ্টিনন্দন। কিন্তু এগুলির রং হাল্কা, অতটা মচমচে খেতেও নয়, যেমনটি হলুদ ড্রাগন ফ্রুটের ক্ষেত্রে দেখা যায়। ভিয়েতনামী লাল ড্রাগনগুলির ফ্লেভার বা গন্ধ বেশ চমকপ্রদ।
ইউরোপের বাজারে ড্রাগন ফ্রুটের চাহিদা মেটায় মূলত ইসরায়েল এবং থাইল্যান্ড। আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের বাজার দখল নিচ্ছে মেক্সিকো এবং মধ্য ও দক্ষিণ আমেরিকার ড্রাগন ফ্রুট উৎপাদনকারী দেশগুলি। এই দেশগুলি এশিয়ার দেশগুলির সঙ্গে প্রতিযোগিতায় অবতীর্ণ হয়েছে। কারণ এশিয়ার দেশগুলোর চাইতে এই দেশগুলির ভৌগোলিক অবস্থান নিকটে।
মধ্য আমেরিকার দেশগুলোর মধ্যে নিকারাগুয়া সবচাইতে বেশি ফল উৎপাদন করে এবং এখানকার লাল ড্রাগন আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, ইউরোপ এবং জাপানে সরবরাহ করা হয়।
কলম্বিয়া হলুদ ড্রাগন উৎপাদন ও সরবরাহের ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য দেশ। এখানকার ফলের গুণগত মান অধিক, স্বাদ অসাধারণ, আকারে বড়। এখানকার হলুদ ড্রাগন আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রে যায়।
হলুদ ড্রাগনগুলি সবচেয়ে মিষ্টি এবং সবচাইতে আদরণীয়। কলম্বিয়ার ড্রাগন এমন সময় বাজারে আসে যখন অন্য কোনো ড্রাগন দখল নিতে পারে না। কারণ এখানকার ফল নভেম্বর থেকে ফেব্রুয়ারী মাসে চয়ন করা যায়, যখন অন্য দেশগুলির বাজারে ফলই আসে না।
ইকুয়েডর হলুদ এবং লাল, উভয় প্রকার ড্রাগনই উৎপাদন করে। গুয়াতেমালা, এল সালভাদর, হন্ডুরাস, কোস্টারিকার ড্রাগন ফলের উৎপাদন একেবারেই ক্ষুদ্র পরিসরে। এইসব আলোচনা করা হচ্ছে একারণেই যে, আগামী দিনে ভারতীয় ড্রাগন ফ্রুটের উৎপাদন ও বৈদেশিক রপ্তানি যেন বাড়ানো যায়। কোথায় তার বাজার, তা জানা।
বিশ্ব বাজারে চার ধরনের ড্রাগন ফ্রুট পাওয়া যায়।
১. লাল ত্বক এবং সাদা শাঁস __Hylocereus undatus_ ভিয়েতনাম এবং থাইল্যান্ডে লভ্য।
২. লাল ত্বক এবং লাল শাঁস _Hylocereus polyrhizus_ মূল উৎপাদন অঞ্চল ইসরায়েল ও মালয়েশিয়া।
৩. লাল ত্বক এবং বেগুনি শাঁস _Hylocereus costaricencis_ গুয়াতেমালা, নিকারাগুয়া, ইকুয়েডর এবং ইসরায়েল থেকে আসে।
৪. হলুদ ত্বক এবং সাদা শাঁস _Hylocereus selenicerus_ কলম্বিয়া এবং ইকুয়েডরে লভ্য। এই প্রজাতিগুলির বিশ্ব বাজারে শেয়ার যথাক্রমে ৯৪%, ৪%, ১.৫% এবং ০.৫%
বিশ্বে ড্রাগন ফ্রুটের আনুমানিক চাষের এলাকা ১.১২ লক্ষ হেক্টর, উৎপাদন ২.১ মিলিয়ন টন। ড্রাগন ফ্রুট উৎপাদনের শীর্ষস্থানীয় দেশগুলো হল ভিয়েতনাম, চীন, ইন্দোনেশিয়া, থাইল্যান্ড, তাইওয়ান, মালয়েশিয়া, ফিলিপিন্স, কম্বোডিয়া, ভারত এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। তিনটি প্রধান দেশ ভিয়েতনাম, চীন এবং ইন্দোনেশিয়া বিশ্ব ড্রাগন ফ্রুট উৎপাদনের ৯৩% দখল নিয়েছে। এর মধ্যে ভিয়েতনাম একলাই অধিকার করে আছে ৫১.১% এলাকা। অর্থাৎ ৫৫,৪১৯ হেক্টর, ফলন ১ মিলিয়ন মেট্রিক টন। তার বাজার মূল্য ৮৯৫.৭ মিলিয়ন ডলার।
ভারতের ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা
বিশ্ব বাজারে ড্রাগন ফলের রপ্তানিকারক দেশ হিসাবে ভারতের স্থান নেই। কিন্তু আগামী দিনে এই চাষের এলাকা বাড়িয়ে এবং ফলনের গুণমান উন্নত করে এবং বিশেষ করে জৈবিক পদ্ধতিতে চাষ করে এর বিশ্ব বাজার বাড়িয়ে তুলতে হবে। আমরা যেন দেখতে পাই, আগামী পাঁচ বছরের মধ্যে ভারতবর্ষও ড্রাগন ফল উৎপাদনে, প্রক্রিয়াকরণে এবং রপ্তানিতে এগিয়ে গেছে। যেহেতু ভারতবর্ষের শুষ্ক ও অনুর্বর জমিতে, নানান জায়গায় ছড়িয়ে (Cluster cultivation করে) এই ফল চাষ অসম্ভব নয়, তাই খরাপ্রবণ ও পাহাড়ি এলাকায় চাষ বাড়ানোর চেষ্টা করতে হবে। ভারতে এই ফলের সম্ভাব্য এলাকা হচ্ছে ক্ষয়প্রাপ্ত জমি এবং বৃষ্টি নির্ভর এলাকা। এই ফসল জৈবিক ও অজৈবিক চাপ সইতে পারে। এই ফসল টেঁকসই কৃষির মূল্যবান অঙ্গ। ক্ষয়প্রাপ্ত জমিতে এই ফসলের চাষ নিবিড়ভাবে করলে অধিক ফলনশীল জমিকে ব্যবহার করতে হবে না।
ড্রাগন ফলের চাষ পদ্ধতি
চারা রোপণ ও দূরত্ব
ড্রাগন ফ্রুটের ব্যাপক বংশবিস্তার করা হয় কাটিং পদ্ধতিতে। বীজের থেকে চারা তৈরি করা গেলেও, তা ব্যবহারযোগ্য হতে অনেকটা সময় নেয়। তিন বছর তো লাগেই। এজন্য বীজের চারার প্রচলন নেই। কিন্তু কাটিংএ চারা রেডি হয়ে যায় দেড় মাসের মধ্যেই। এই কাটিং করার কাজটিও সহজ, কারণ খুব সহজেই তাতে শিকড় গজিয়ে যায়। দক্ষিণবঙ্গের জল হাওয়ায় প্রায় সারা বছরই নার্সারীতে চারা তৈরি করা যেতে পারে৷ অবশ্য বর্ষায় তাড়াতাড়ি শিকড় গজায়৷ গাছের কায়াদান বা ট্রেনিংয়ের পর নানান সময়ে দেখা যায় এর পর্ণকাণ্ডগুলি ক্রমশ ঝুঁকে নিচের দিকে নেমে আসছে এবং ভূ-ভাগ ছুঁয়ে যাচ্ছে। এ অবস্থায় কাণ্ডল অংশ ছাঁটতেই হবে৷ তখন তার ডালপালা কাস্তে দিয়ে কেটে নার্সারীর কেয়ারিতে কাটিং হিসাবে ছোট ছোট টুকরো (৫০-৭০ সেন্টিমিটার দৈর্ঘ্য) আকারে রোপণ করা যেতে পারে।
ড্রাগনের চারা বসাতে হয় খু্টির চারপাশে। এই খু্ঁটি আংশিক স্থায়ী বা স্থায়ী হতে পারে। স্থায়ী বলতে সিমেন্ট, বালি, স্টোনচিপ দিয়ে তৈরি কংক্রিটের খুঁটি, তার মাথায় লোহা বা কংক্রিটের রিং বা ঝুড়ি, এবং/অথবা লোহার তার। অস্থায়ী খুঁটি তৈরি হয় বাঁশ এবং অব্যবহৃত টায়ার দিয়ে।
খুঁটির দূরত্ব দিয়েই নিরূপণ হয় গাছ থেকে গাছ বা সারি থেকে সারির দূরত্ব। পাকাপোক্ত খুঁটিতে চারপাশে চারটি করে চারা লাগানো হয়। এই উলম্ব খুঁটিগুলির দূরত্ব দেওয়া হয় দুই থেকে তিন মিটার। দুই মিটার দূরত্বে খুঁটি থাকলে হেক্টরে (সাড়ে সাত বিঘায়) আড়াই হাজার খুঁটির প্রয়োজন হবে। প্রতি খু্টিতে চারটি চারা হিসেবে হেক্টরে মোট চারা লাগবে দশহাজার। অর্থাৎ বিঘায় খুঁটির সংখ্যা হবে ৩৩০ টি এবং বিঘায় প্রায় ১৩৩০ টি। এই খুঁটি গুলির খরচ বেশ খানিকটা, তাই প্রারম্ভিক খরচও বেশি। অবলম্বন খুঁটিগুলির উচ্চতা হবে প্রায় দেড় মিটার, তার কিছুটা মাটির নিচে প্রোথিত থাকবে যাতে সার্পোটিং জোর পায়।
এইভাবে দেখা যায় ড্রাগন চাষে প্রাথমিক খরচ হেক্টর প্রতি প্রায় ৭.৫ লক্ষ বা বিঘা প্রতি এক লক্ষ টাকার মতো, যাকে উচ্চ বিনিয়োগই বলা চলে।
সেচ ব্যবস্থাপনা (Irrigation)
এই ফসলে কতটা সেচ লাগবে তা নির্ভর করে কোন্ ধরনের মাটিতে অথবা কোন কৃষি-জলবায়ু অঞ্চলে ফসল চাষ হচ্ছে তার উপর। গাছের ক্যানোপি গ্রোথ বা শাখা-প্রশাখার বিস্তার কতটা, তার উপর ভিত্তি করেও সেচের মাত্রা কম-বেশি হয়। ড্রাগন ফল খুব অল্প বৃষ্টিপাতে এবং ক্ষরাপ্রবণ অঞ্চলে বেঁচে থাকে। কিন্তু উন্নত মানের ফলের জন্য নিয়মিত জলসেচের প্রয়োজন হয়। এটি যেহেতু ফণীমনসা গোত্রের উদ্ভিদ। এর জল ধারণ ক্ষমতা খুবই উন্নত। কিন্তু নিয়মিত জলসেচ করলে এর ফুল ও ফলের বৃদ্ধিতে সাহায্য করে।সাধারণভাবে বলা যায়, এক একটি ঢিপির জন্য শুখা মরশুমে দুই বার কলসি-সেচ/বালতি-সেচ দিতে হবে। এজন্য প্রতিবার দুই থেকে চার লিটার জল লাগবে প্রতিটি ঢিপিতে। অনেকে স্থানীয় ক্ষুদ্র জলসেচ দেওয়ার কথা বলে থাকেন। এর মাধ্যমে সরবরাহ করা জলের কার্যকারিতা বৃদ্ধিপায়। তেমনি অতিরিক্ত জল নষ্ট হয় না, ফুল ও ফল ঝরে যায় না, এমনকি পিঁপড়ের আক্রমণও কম হয়।
ড্রিপ ইরিগেশন এই ফসলের জন্যও ভাবা যেতে পারে। তবে মাটিতে ড্রিপের নালিকা ছড়িয়ে থাকবে, না খুঁটির উপর থেকে ফোয়ারা আকারে হাল্কা কুয়াশার মতো ছড়িয়ে দিতে হবে, তা ভাবা দরকার। হাল্কা ফোয়ারা-সেচ দিলে ড্রাগনের ভাসমান কাণ্ডল শিকড়গুলি রসসিক্ত হয়, এবং তা গাছের বিস্তার ও উৎপাদনমুখী করে তোলে। মাটিতে ড্রিপ-সিস্টেম ছড়ানো থাকলে পাওয়ার-টিলার চালাতে অসুবিধাজনকও হয়। তবে সেচের ক্ষেত্রে মনে রাখার বিষয় এই, ড্রাগন ফ্রুটের শিকড় থাকে অগভীরে, মাটির উপরিস্তরে। তা যেন সহজে শুকিয়ে না যায়। নিচু জমিতে বা জলাবদ্ধ স্থানে যখন কেয়ারিগুলি বা বেডগুলি উঁচু করে গাছ লাগানো হয়, তখন এমনিতেই গাছের শিকড় কিছুটা উপরে থাকে। এটা বর্ষার মরশুমের জন্য উপযোগী হলেও, শুখা মরশুমের জন্য ঢিপি শুকিয়ে যাওয়া একটি সমস্যা। এটা মনে রেখে সেচ ক্যালেণ্ডার তৈরি করতে হবে বাস্তবানুগ বিচার করে।
সার প্রয়োগ
এই গাছের ফলন নির্ভর করে সার এবং সঠিক সময়ে তার প্রয়োগের ওপর। এর মূল অগভীর হওয়ায় খুব সহজেই তা অল্প পরিমান সার থেকে খাদ্যগুণ সংগ্রহ করে নিতে পারে। রাসায়নিক ও জৈব সার এক সাথে মিশিয়ে প্রয়োগ করলে খুব ভালো ফলন পাওয়া সম্ভব।
ড্রাগন ফ্রুটে জৈব সার প্রয়োগ
(Organic manure)
ড্রাগন ফ্রুট সাধারণত অনুর্বর জমিতে চাষ করা হয়। তাই তার বাহ্যিক পুষ্টি সরবরাহ মাত্রা-মতো এবং বিজ্ঞানসম্মত হওয়া প্রয়োজন। প্রয়োজনে বছরে একাধিক বার (১ থেকে ৩ বার) জৈবসার দিতে হতে পারে। তাতে ফলের আকার ও ওজন বাড়ে, গুণগত মানও বৃদ্ধি হয়। ঢিপিতে দেড়/দুই ঝুড়ি ভালো করে পচানো গোবর সার (আনুমানিক মাত্রা ১৫-২০ কেজি) বা এক ঝুড়ি ভার্মি কম্পোস্ট বা কেঁচোসার দিতে হবে। যদি পোল্ট্রি লিটার বা মুরগী-সার পাওয়া যায় অথবা নিমখোল সুলভ হয়, তাও প্রয়োগ করা যেতে পারে। একই সাথে প্রতি ঢিপিতে বছরে ২০ কেজি পাতা পচা সার দিতে হবে।
ড্রাগন ফ্রুটে অজৈব সার প্রয়োগ
(Fertilizer dosage)
ড্রাগনের এক একটি ঢিপিতে খুঁটি বা পোলের চারদিকে রোপিত চারটি চারার জন্য মোট ৪৫০ গ্রাম করে নাইট্রোজেন অর্থাৎ প্রায় ১ কেজি ইউরিয়া, ৩৫০ গ্রাম করে ফসফরাস বা দুই কেজির সামান্য বেশি মাত্রায় সিঙ্গেল সুপার ফসফেট এবং ৩০০ গ্রাম করে পটাশিয়াম বা ৫০০ গ্রামের মতো মিউরিয়েট অফ পটাশ দিতে হবে৷ রাসায়নিক সার প্রয়োগ করার পর হাল্কা সেচ দেওয়া দরকার। অনেকসময় ফার্টিগেশন পদ্ধতিতে বিন্দুপাতি সেচ বা ড্রিপ ইরিগেশনের সঙ্গে রাসায়নিক সার মিলিতভাবে নালিকার মধ্যে দিয়ে শিকড়ের স্তরে পৌঁছে দেবার ব্যবস্থা হতে পারে। তাতে প্রযুক্ত রসায়নের মাত্রা অনেকটাই কমিয়ে ফেলা সম্ভব হয়। ড্রিপ ইরিগেশন বা ফার্টিগেশনের সরকারি সুবিধা পেতে স্থানীয়/জেলা উদ্যানপালন আধিকারিকের সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে তুলুন।
পুষ্টি ব্যবস্থাপনা
(Nutrition management)
সুপারিশ মতো যে রাসায়নিক সারের হিসেব দেওয়া হল, ফসলে তা চারটি দফায় প্রয়োগ করতে হবে। বৃদ্ধির ফুলেল দশার পূর্বে নাইট্রোজেন ও ফসফরাস দু’টোই ১০% করে এবং পটাসিয়াম ৩০% প্রয়োগ করতে হবে। ফলনশীল দশায় যথাক্রমে ২০, ৪০ এবং ২৫ শতাংশ N, P এবং K প্রয়োগ করতে হয়। ফসল চয়নের পর যথাক্রমে ৩০, ২০ এবং ৩০ শতাংশ N, P এবং K দিতে হবে। বছরের একদম শেষে, অর্থাৎ চয়নের দুই মাস পর ৪০, ৩০ এবং ১৫ শতাংশ N, P এবং K প্রযুক্ত হবে। গাঙ্গেয় পশ্চিমবঙ্গে ফল আসা শুরু হয় এপ্রিল মাসের শেষ থেকে। তখন খুদি পুষ্প মুকুল আসে এর পর্ণকাণ্ডে। তাই প্রথম দফার সার দিতে হবে মার্চ মাস নাগাদ। ফল ধারণের সময় বলতে জুন মাসের প্রথম থেকে শুরু হয়৷ কয়েক দফায় ফল দেওয়া চলে সেপ্টেম্বর মাস পর্যন্ত। অক্টোবরের মাঝামাঝি শেষ ফলন পাওয়া যায়। তৃতীয় দশায় সার দিতে হবে অক্টোবর মাস নাগাদ। আর চতুর্থ দফায় সার প্রয়োগ করতে হবে ডিসেম্বর মাসে।
রোগ-পোকার সমস্যা
ড্রাগন ফ্রুটের ক্ষতিকর পতঙ্গের মধ্যে দয়েপোকা বা মিলিবাগ, স্কেল ইনসেক্ট বা এঁটুলি পোকা, কাঠ পিঁপড়ে, নিমাটোড বা কৃমিশত্রুই প্রধান। ভারতের কোনো অঞ্চলে অবশ্য ফ্রুটফ্লাই বা ফলের মাছির আক্রমণ দেখা যায়। এই মাছি থেকে ক্ষতির মাত্রা কোথাও কোথাও ৩৫ শতাংশ পর্যন্ত হতে পারে। ড্রাগন ফলে ছত্রাক ও ব্যাক্টেরিয়া ঘটিত কয়েকটি রোগের লক্ষণ দেখা যায়; যেমন অ্যান্থাকনোজ, ব্রাউন স্পট বা বাদামী দাগ, কাণ্ডপচা বা স্টেমরট এবং ক্যাঙ্কার রোগ৷ তবে অন্যান্য ফলের চাইতে এই ফসলে পোকামাকড় ও রোগব্যাধির আক্রমণ তুলনামূলক ভাবে অনেকটাই কম। প্রখর সূর্যালোকে রোদ পোড়া বা স্করচিং-এর সমস্যা দেখা যায়। মাটিতে ক্যালসিয়ামের অভাব জনিত লক্ষণ গাছেও ফুটে ওঠে। ড্রাগন ফ্রুটে পাক ধরলে কাঠবিড়ালি, ইঁদুর ও পাখির আক্রমণ দেখা দেয়। কোথাও এরা ৮ শতাংশ পর্যন্ত ফসলের ক্ষতি করে।
ফসল চয়ন
গাঙ্গেয় পশ্চিমবঙ্গে নদীয়া জেলায় জুন মাসের একদম প্রথম থেকে পাকা ফল তুলতে পারা যায়। কোথাও কোথাও মে মাসের মাঝামাঝি থেকে ফসল চয়ন শুরু হয়। এরপর থেকে অক্টোবরের মাঝামাঝি পর্যন্ত শেষ ফলনটি তোলা যায়। অর্থাৎ সাড়ে চার মাস থেকে পাঁচ মাস এ রাজ্যে ড্রাগনের ফলন মেলে। ফল পাকলে তার গাত্রবর্ণ সবুজ থেকে ধীরে ধীরে লাল হতে থাকে। চার সপ্তাহের মধ্যে এই রঙ পরিবর্তনের বিষয়টি নজর পড়ে। তারপর গাঢ় হতে থাকে ফলের গাত্রবর্ণ। বেশি পেকে গেলে ফল ফেটে শাঁস বেরিয়ে এলে পাখি, কাঠবিড়ালি ঠুকরিয়ে খায়। পিঁপড়েরাও আক্রমণ করে। কাটিং লাগানোর পর দেড় বছর থেকে ফল আসে। তৃতীয় বছর থেকে এক একটি খুঁটির চারটি গাছের সমন্বিত ঢিপি থেকে বছরে একশোটি ফল পাওয়া যায়। নদীয়ায় চার থেকে পাঁচটি ফলে এক কেজি ওজন হয়। রোপণ দূরত্ব অনুযায়ী ফলন নির্ভর করে। সাড়ে তিন বছরের ঢিপিতে এক হেক্টর জমি থেকে বছরে ৩০ থেকে ৫০ টন ফলন পাওয়া যেতে পারে। অর্থাৎ বিঘায় চার থেকে সাড়ে ছয় টন ফলন। এক কেজি ড্রাগন ফ্রুট যদি কৃষক ১০০ টাকায় বিক্রি করতে পারেন, তবে এক বিঘায় চার থেকে সাড়ে ছয় লক্ষ টাকা বছরে ফল বেচে পাওয়া যাবে। জমি থেকে চারা বেচেও অতিরিক্ত লাভ হয়। পরিচর্যা ও ঋণের খরচ বাদ দিলে বছরে আয় হতে পারে বিঘা প্রতি আড়াই থেকে চার লক্ষ টাকা।