চলে গেলেন ডঃ শ্যামলকান্তি চক্রবর্তী

অশোক সেনগুপ্ত
আমাদের ভারত, কলকাতা,২২ জুলাই: চলে গেলেন শ্যামলদা। বিশিষ্ট মিউজিয়াম বিশারদ ডঃ শ্যামলকান্তি চক্রবর্তী। বৃহস্পতিবার রাতে কলকাতার রামকৃষ্ণ মিশন সেবা প্রতিষ্ঠানে তিনি শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেন। বয়স হয়েছিল ৭৮ বছর। এক পুত্র, পুত্রবধূ ও তাঁদের এক সন্তান ছাড়াও তিনি রেখে গিয়েছেন অগণিত ছাত্রছাত্রী, গুণমুগ্ধ ও শুভানুধ্যায়ীদের। পরিচিতির একটা বড় বৃত্ত ছিল তাঁর। দক্ষ লেখক, কবি, বক্তা এবং প্রশাসকের পরিচিতিও রেখেছেন নানা সময়।

অল ইন্ডিয়া আর্ট হিস্ট্রি কংগ্রেস এবং নরেন্দ্রপুরের চিন্তামণি কর ফাউন্ডেশনের (ভাস্কর ভবন) চেয়ারম্যান শ্যামলবাবুর মূল কর্মজীবন কেটেছে ভারতীয় জাদুঘরে। ১৯৬৫-তে সেখানে যোগ দেন কিউরেটর হিসাবে। ধাপে ধাপে পদোন্নতির পর সেখানকার অধিকর্তা হন। এ ছাড়াও ছিলেন জাতীয় গ্রন্থাগারের প্রাক্তন অধিকর্তা। নানা সময় যুক্ত ছিলেন কেন্দ্রীয় মানব সম্পদ উন্নয়ন মন্ত্রক, আইকম, গুরুসদয় সংগ্রহশালা, বারাকপুর গান্ধী স্মারক সংগ্রহশালা, ভাষা স্মারক সমিতি, বঙ্গ সংস্কৃতি সম্মেলন, ক্যালকাটা আর্ট ফাউন্ডেশন, বাংলাদেশের রাজশাহী বরেন্দ্র রিসার্চ মিউজিয়াম প্রভৃতির সভাপতি, পরামর্শদাতা, পরিচালনমন্ডলির সদস্য প্রভৃতি হিসাবে। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় এবং রবীন্দ্র ভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের অতিথি অধ্যাপক এবং পিএইচডি-র পরীক্ষক হিসাবেও যুক্ত ছিলেন।

শ্যামলবাবুর জন্ম বাংলাদেশে। শৈশবেই চলে আসেন কলকাতায়। তাঁর পরিবারসূত্রে জানা যায়, প্রথমে চেতলা কর্পোরেশন স্কুল, তারপর চেতলা বয়েজে। স্কুলে থাকাকালীনই ‘আগামী’ নামে একটি হাতে লেখা পত্রিকা বার করেন। তখন থেকেই লেখালেখির ঝোঁক। লেখা সংগ্রহের জন্য যেতেন সমকালের বিশিষ্টদের কাছে। ১৯৫৮-তে স্কুল ফাইনাল উত্তীর্ণ হওয়ার পর আশুতোষ কলেজ থেকে আইএ পাশ করেন শ্যামলবাবু। সংস্কৃতে স্নাতক হওয়ার পর পুরাতত্বে স্নাতকোত্তর। পিএইচডি-র বিষয় ছিল ‘পত্রবিলাস’। বেশ ক’টি বই লিখেছিলেন। আনন্দবাজার পত্রিকায় একসময় নিয়মিত লিখতেন ‘শ্যাম কাশ্যপ’ নামে। ঘুড়ি ওড়ানোর ইতিহাস থেকে মিশরের মমি— লিখেছেন হাজারো বিষয়ে। পুরাতত্ব এবং জাদুঘরের বিষয়কে নানাভাবে ছড়িয়ে দেওয়ার চেষ্টা করেছেন আমজনতার মধ্যে। কার্জন পার্কে ভাষা স্মারক উদ্যানে অক্ষরবৃক্ষে স্থান পেয়েছিল ভারতের বিভিন্ন ভাষার অক্ষর। পার্ক স্ট্রিট পাতাল রেল স্টেশনে তৈরি করেছিলেন জাদুঘরের গ্যালারি। পরবর্তীকালে সেখানে প্রতিস্থাপিত হয় মাদার টেরিজার স্মৃতিপ্রতীক।

পরবর্তীকালে থাকতেন দক্ষিণ কলকাতায় নিজের বাড়িতে। চার ভাই, দু’বোন। বাকি তিন ভাই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে প্রতিষ্ঠিত। বড় বোন প্রয়াত হয়েছেন গত অক্টোবর মাসে। ছোট বোন অনীতা চক্রবর্তী নিউটন থাকেন লন্ডনে। গত ১১ জুলাই শ্যামলবাবুর হৃদযন্ত্রে আক্রান্ত হওয়ার খবর পেয়ে দ্রুত কলকাতায় চলে আসেন। শ্যামলবাবুর স্ত্রী শিপ্রা চক্রবর্তীও কাজ করতেন ভারতীয় জাদুঘরে। বছর চার আগে প্রয়াত হয়েছেন। বাড়িতে প্রদীপ ধরাতে গিয়ে আচমকা পোষাকে আগুন ধরে যায়। বাঙুর হাসপাতালে ক’দিন চিকিৎসাধীন থাকার পর চলে যান চিরকালের মত। পুত্র, পুত্রবধূ ও নাতনি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী। তাঁরাও অতি সম্প্রতি কলকাতায় চলে এসেছেন।

গত শতকের আশির দশকের প্রথমার্দ্ধে আমি যখন আনন্দবাজার পত্রিকায়, সংবাদ সংগ্রহের সূত্রে শ্যামলদার সঙ্গে আমার পরিচয়। তখন তিনি ভারতীয় জাদুঘরের এডুকেশন অফিসার। সেই সম্পর্ক বজায় ছিল সেদিন পর্যন্ত। গত বাংলা নববর্ষের আগে ফোনে তাঁর সাক্ষাৎকার নিয়েছিলাম শৈশবের নববর্ষ নিয়ে। অসংখ্য স্মৃতি উঁকি মারছে। আমার মেয়ে হয়েছে শুনেই তাঁর তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া, অশোকের মেয়ে যখন সঙ্ঘমিত্রাই নাম হবে। হয়েছিলও তাই। সঙ্ঘমিত্রার অন্নপ্রাশনে সেকালের কিছু বিশিষ্ট কবির লেখা একটি স্মরণিকা প্রকাশিত হয়। তাতে শ্যামলদা একটা সুন্দর ছড়া লিখে দেন।

প্রায় শেষ দিন পর্যন্ত লেখা আর পড়াই ছিল দিনের প্রধান কাজ। যদিও চোখের সমস্যায় ছোট অক্ষর পড়তে সমস্যায় পড়তেন। শেষদিকে লিখছিলেন ‘পেইন্টেড ডেলিকেট অফ বেঙ্গল’— প্রস্তরযুগ থেকে আধুনিককাল পর্যন্ত ছবির বিবর্তন নিয়ে। অনীতা চক্রবর্তী নিউটন জানান, শুক্রবার হাসপাতাল থেকে শ্যামলবাবুর দেহ নিয়ে আসা হয় বাড়িতে। দুপুরে শেষকৃত্যর জন্য নিয়ে যাওয়া হয় কেওড়াতলা মহাশ্মশাণে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *