Sharat Literature, শরৎ সাহিত্যে সমাজ ও অর্থনীতির খোঁজে আলোচনাচক্র

আমাদের ভারত, ২৪ আগস্ট: অরবিন্দ দুবে—
“সাম্প্রতিককালে শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের সাহিত্য নিয়ে নতুন করে চিন্তাভাবনার প্রয়াস শুরু হয়েছে। এটি অত্যন্ত আশার কথা, আনন্দের কথা।” শুক্রবার কলকাতায় কথাশিল্পী শরৎচন্দ্র স্মরণে একটি আলোচনাসভায় এই মন্তব্য করেন রাষ্ট্রবিজ্ঞানের বিশিষ্ট অধ্যাপিকা, শরৎ-গবেষিকা ও লেখিকা ডঃ কুমকুম চট্টোপাধ্যায়।

সভামুখ্য হিসেবে ড: কুমকুম চট্টোপাধ্যায় তাঁর বক্তব্য রাখেন। প্রথম বক্তা ড: বাসবী চক্রবর্তীর বিষয় ছিল ‘শরৎচন্দ্রের কথাসাহিত্যে সমাজ’। প্রথমে তাঁর বক্তব্য নিয়ে আলোচনা করেন ড: চট্টোপাধ্যায়। যে কোনো সাহিত্য বিশ্লেষণ করতে গেলে তাকে তাত্ত্বিক কাঠামোর সাপেক্ষে আলোচনা করা জরুরি। তা না হলে আলোচ্য বিষয়বস্তুর মধ্যে সংহতি নির্মাণ করা যায় না।

বাসবী চক্রবর্তী সূচনাতেই বলেন যে, সাহিত্য ও সমাজ পরস্পরের পরিপূরক। তিনি Sociology of Literature বিষয়ে বিস্তৃত বক্তব্য রাখেন। তারপর শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের জীবন কিভাবে তাঁর সাহিত্য সৃষ্টিকে প্রভাবিত করেছে সে বিষয়ে আলোকপাত করেন। শরৎচন্দ্রের সাহিত্যে ‘নারী’ এক বিশেষ জায়গা অধিকার করে আছে। সেই প্রসঙ্গ উল্লেখ করে বাসবী ‘চরিত্রহীন’, ‘গৃহদাহ’, ‘দত্তা’, ‘বামুনের মেয়ে’ ইত্যাদি কাহিনীর ব্যাখ্যা ও বর্তমান প্রাসঙ্গিকতা নিয়ে গুরুত্বপূর্ণ কিছু কথা বলেন। এখানে ‘মানবীবিদ্যাচর্চা’র তাত্ত্বিক দৃষ্টিকোণ গুরুত্বপূর্ণ।

এরপর আমাদের সমাজে জাতিভেদ প্রথার অভিশাপ ও নিম্নবর্গের অবস্থানকে শরৎচন্দ্র কিভাবে তুলে ধরেছেন সেই বিষয়ে আমাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন এই বক্তা। এখানে আমরা Subaltern Studies- এর অঙ্গনে প্রবেশ করতে পারি। এই প্রেক্ষাপটে তিনি কুমকুম চট্টোপাধ্যায়ের ‘শরৎচন্দ্র: অন্বেষণে বিশ্লেষণে’ বইটির উল্লেখ করেন ও ইতিবাচক মন্তব্য করেন।

পরবর্তী বক্তা ছিলেন বিশিষ্ট সাংবাদিক শ্রী অশোক সেনগুপ্ত। তাঁর বিষয় ‘শরৎচন্দ্রের কথাসাহিত্যে অর্থনীতি’। যুগের পরিবর্তনের সঙ্গে অর্থনীতির প্রায় আমূল পরিবর্তন হয়েছে সেই কথা সূচনাতেই তিনি উল্লেখ করেন। সেই সময়কার সামন্ততান্ত্রিক সমাজের শোষণকে শরৎচন্দ্র কেমন গভীর ভাবে উপলব্ধি করেছেন সেই কথা বলেন। প্রসঙ্গত, তিনি ‘দেবদাস’, ‘পল্লীসমাজ’, ‘দত্তা’, ‘মহেশ’ ইত্যাদি কাহিনীর বিশেষ বিশেষ অংশ পাঠ করে শোনান। তার ফলে শ্রোতারাও সাহিত্য পাঠে সামিল হন এবং বিষয়টি খুবই উপভোগ্য হয়ে ওঠে। আলোচনায় ‘পথের দাবী’ উপন্যাসটিও জায়গা করে নেয়। অশোক সেনগুপ্তের এই পাঠভিত্তিক উপস্থাপনা আলোচনায় একটি আলাদা মাত্রা নিয়ে আসে।

দুই বক্তার বক্তব্য সম্পর্কে আলোচনা করার পর ড: কুমকুম চট্টোপাধ্যায় তাঁর কিছু পর্যবেক্ষণ তুলে ধরেন। প্রথমে তিনি বলেন যে, শরৎচন্দ্রের জীবৎকালে ভারত পরাধীন ছিল। তাই সামন্ততান্ত্রিক শোষণের সঙ্গে তখন যুক্ত হয়েছিল ঔপনিবেশিক শোষণ। শরৎ সাহিত্য সেই সচেতনতার পরিচয় বহন করে। নিম্নবর্গের মানুষরা এই যৌথ শোষণের চাপে কিরকম জর্জরিত ছিল তার কথা তিনি তুলে ধরেন।

নারীর কথা বলতে গিয়ে ড: চট্টোপাধ্যায় ‘অরক্ষণীয়া’ কাহিনীটির উল্লেখ করেন যেখানে লাঞ্ছিতা নায়িকার সঙ্গে লেখক শরৎচন্দ্র একেবারে একাত্ম হয়ে গিয়েছেন। নারীর বেদনা এইভাবে উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন ঈশ্বর চন্দ্র বিদ্যাসাগর।

এতক্ষণ সাম্প্রদায়িকতার বিষয়টি আলোচনায় আসেনি। সবশেষে সভামুখ্য সেই প্রসঙ্গে শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের মানসিকতার কথা উল্লেখ করেন। ‘পল্লীসমাজ’ উপন্যাসে নায়ক রমেশের জ্যাঠাইমার মুখে হিন্দু- মুসলমান বিষয়ে মন্তব্য প্রকৃত অর্থে লেখকেরই বক্তব্য। আর এই উদার মন্তব্য গ্রামের এক তথাকথিত অশিক্ষিত নারীর মুখে উচ্চারণ করিয়ে শরৎচন্দ্র নারীকে অসামান্য মহিমা দান করেছেন। আবার মুসলমান গফুর তার সন্তানসম বলদের নাম রাখে মহেশ, যেটি হিন্দুদের একটি আরাধ্য নাম। শরৎ সাহিত্যে লেখকের এই অসাম্প্রদায়িক মনোভাব একেবারে স্বতস্ফূর্তভাবে বেরিয়ে এসেছে।

এই অধিবেশনে দুই বক্তা বাসবী চক্রবর্তী সমাজবিদ্যার অধ্যাপিকা। অশোক সেনগুপ্তের বিষয় অর্থনীতি। আর সভামুখ্য কুমকুম চট্টোপাধ্যায় রাষ্ট্রবিজ্ঞানের অধ্যাপিকা। তিনজনই সমাজ বিজ্ঞানের আলোয় শরৎচন্দ্রকে বিশ্লেষণ করেছেন এবং বর্তমান চাহিদা অনুযায়ী পুরো বিষয়টিকে তাত্ত্বিক কাঠামোর মধ্যে নির্মাণ করার উদ্যোগ নিয়েছেন। তাঁদের এই উদ্যোগ অবশ্যই প্রশংসার দাবি রাখে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *