ড. কল্যাণ চক্রবর্তী
আমাদের ভারত, ৪ ফেব্রুয়ারি: মৃত্তিকা জননীর অকৃপণ স্তন্যরসে প্রতিপলিত মৃত্তিকাশ্রয়ী কৃষির সামূহিক সম্ভার হল জৈব ফসল বা অর্গানিক ক্রপ। এটিই হল প্রকৃত অর্থে ‘ধরণীর নজরানা’; এক শাশ্বত অচিন্ত্য বিস্ময়, যার দানে ভরে ওঠে দেবী অন্নপূর্ণার ভাণ্ডার। মাটির প্রাকৃতিক খাদ্যভাণ্ডারকে ব্যবহার করে যে ফসল উৎপাদিত হয় তাই প্রাকৃতিক শস্য। প্রকৃতিই তার সারের যোগানদার, মাটির স্বাভাবিক আর্দ্রতা তাকে রসসিক্ত করে, বৃষ্টির জল তার সেচের চাহিদা মেটায়, অণুখাদ্যের যোগান দিতে সহায়ক হয়ে ওঠে ভৌম জীবাণু-সমষ্টি, আর সর্বোপরি অফুরন্ত সূর্যালোক তার সালোকসংশ্লেষ প্রক্রিয়ার সহায়ক হয়ে ওঠে।
নির্মল বসুন্ধরার যা নিয়ত আশীর্বাদ, তারই খাদ্য-সংস্কৃতি হচ্ছে অর্গানিক ফুড। সহজ কথায় নিরাপদ আহার হল অর্গানিক ফুড।
ফল ও স্যালাড যেমন (টম্যাটো, গাজর, বীট, মটরশুঁটি, পেঁয়াজ, মূলো, লেটুস, স্যালারি, ধনেপাতা, পুঁদিনাপাতা প্রভৃতি) কাঁচা খাওয়া হয়, তাই তা জৈব পদ্ধতিতে চাষ করা হলে মানুষ সরাসরি কৃষিবিষ থেকে রেহাই পাবেন। ভারতবর্ষ সমেত নানান দেশের প্রধান খাদ্য ভাত, রুটি এবং আলু, তাই এই খাদ্যগুলিও যাতে বিষমুক্ত করা যায়, তার চেষ্টা শুরু হয়েছে সারাবিশ্বেই। সেইসঙ্গে নানান সব্জি, দুধ, মাছ, মাংস যাতে কীটনাশকের অবশেষ-মুক্ত রাখা যায় তার প্রচেষ্টাও হয়েছে। তাই নানান দেশের শপিংমলগুলিতে অর্গানিক প্রোডাক্ট বিপণন করা হচ্ছে। অর্গানিক সব্জি ও শস্য কেন?
আমরা দৈনিক খাদ্য গ্রহণ করি কেবল পেট ভরাতে নয়, কেবল পুষ্টি লাভ করতেও নয়, নীরোগ থাকতে এবং শারীরিক ও মানসিকভাবে সুস্থ থেকে সাত্ত্বিক জীবনলাভ করতে। রাসায়নিক-কৃষি অনুসরণ করে সেই পরিবেশবান্ধব জীবনচর্যা সম্ভব নয়। দেহের কোষ-কলায়, নাড়িতে, স্নায়ুতে বিষের অবশেষ নিয়ে; বিষাক্ত নিঃশ্বাস ফেলে সাত্ত্বিক জীবনলাভ সম্ভব নয়। প্রকৃতির মাঝে থাকা মানে প্রকৃতি-দত্ত কৃষি সামগ্রী ভোজন করা, কংক্রিটের জঙ্গলের মধ্যেও যতটা সম্ভব সবুজে-শ্যামলে ভরিয়ে দেওয়া। আর সেজন্যই গাঁয়ের কৃষিক্ষেত্রটিকেই শুধু জৈবকৃষির আওতায় আনা নয়, শহর-নগর-রাজধানীর সূর্যকরোজ্জ্বল বিস্তীর্ণ ছাদ, বারান্দা, জানালার প্রান্তে সুযোগ মত সব্জি ও ফলের গাছ লাগিয়ে তা জৈব-সম্মতভাবে চাষ করলে আমরা সরাসরি জৈব-কৃষিপণ্য পাবো। এমনকি ঘরের ভেতরে সুযোগমতো মাশরুমের চাষও করে নিতে পারব।
রাসায়নিক চাষের দৌরাত্ম্যে বাড়ছে মহিলাদের ব্রেস্ট-ক্যান্সারের মত মারণ রোগ, শিশুদের লিউকেমিয়া, বয়স্ক মানুষের রক্ত ও স্নায়বিক ব্যাধি। বাড়ছে চর্মরোগের প্রকোপ, টিউমার, জিনগত বৈষম্য, অন্তঃক্ষরা নানান গ্রন্থির সমস্যা।
রাসায়নিক কৃষির মূল সমস্যা হল কীটনাশক কেবল নির্দিষ্ট কীটটিকেই মেরে ফেলে না, মারে অসংখ্য নির্দোষ জীবকে। তাদের আবাসস্থল বিষাক্ত করে। টেকনিক্যালি একে বলা হয় নন-টার্গেট টক্সিসিটি বা অ-লক্ষ্য বিষক্রিয়া বা দূষণ। জেনে বা না জেনে এইভাবে আমরা রোজ সারা বিশ্বে অগুন্তি জীবের মৃত্যু ঘটাচ্ছি, অথচ যাদের মারার কথা ছিল না। পরিসংখ্যান এইরকম — কীটঘ্ন প্রয়োগের ৯৮ শতাংশ এবং আগাছানাশকের ৯৫ শতাংশ তার আক্রমণের সীমানা ছাড়িয়ে অন্য প্রজাতিকে ধ্বংস করে। জমি-জিরেতে যে কীটঘ্ন ব্যবহৃত হয় তা ছাপিয়ে চলে যায় বাস্তুতন্ত্রের প্রত্যন্ত অঞ্চলে। কিছুটা হাওয়ার তোড়ে, কিছুটা জলপ্রবাহে, কিছুটা মাটিতে মিশে। এক ক্ষেত থেকে অন্য ক্ষেত, অন্য চারণভূমি, মনুষ্য-বসতি, জলাশয়ে তা অনতিবিলম্বে ছড়িয়ে যায়। সমস্যা আরও বাড়ে যখন কৃষিজীবী মানুষ এই কীটনাশকের অপব্যবহার করে। নির্ধারিত মাত্রার বেশি হারে তা প্রয়োগ করলে পরিবেশ দূষিত তো হয়ই, তার পরেও দেখা যায় কীটনাশকে পোকামাকড় সহনশীল হয়ে যাচ্ছে, অনেক নতুন পোকামাকড় যা একসময় তেমন ক্ষতিকর বলে চিহ্নিত ছিল না, তাও পেস্ট বলে মানত্য পাচ্ছে, মাইনর পেস্ট হয়ে যাচ্ছে মেজর পেস্ট। এ এক অভূতপূর্ব সংকট।
আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের একটি সমীক্ষায় জানা যায়, সেখানকার প্রায় সমস্ত নদীনালা কীটনাশকে দূষিত। ৯০ শতাংশ কূপের জল দূষিত। সেখানে ভৌম জলে এবং বৃষ্টির জলেও কীটনাশকের অবশেষ পাওয়া গেছে। যুক্তরাজ্যের সরকারি রিপোর্টেও প্রায় একই বার্তা। ভারতবর্ষেও যদি এমন সমীক্ষা করা যায় উদ্বেগজনক ফল বেরোবে, প্রকাশিত অনেক ফলই আশঙ্কাজনক। আর একটি সমীক্ষায় জানা গেছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে প্রতি বছর ৭২ মিলিয়ন পাখি কীটনাশক দূষণে মারা যায়। কৃষি দূষণে যুক্তরাজ্যের ১০ প্রজাতির ১০ মিলিয়ন পাখি মারা পড়েছে ১৯৭৯ থেকে ১৯৯৯ সালের মধ্যে। ইউরোপের ১১৬ প্রজাতির পাখি বিলুপ্ত হবার জন্য দিন গুনছে। জমিতে দানাদার কীটনাশকের কয়েকদানা খাবার ভেবে সরাসরি পেটে চলে গিয়ে মৃত্যুর কারণ হয়েছে অসংখ্য ছোটো পাখির। ভারতবর্ষে চড়াই, দোয়েল, চাক দোয়েল, বুলবুলি, মুনিয়া, টুনটুনি, মৌটুসি প্রভৃতি পাখি হারিয়ে যাচ্ছে দ্রুত। আগামীদিনে নীরব বসন্ত বুঝি এভাবেই আসতে চলেছে।
রাচেল কার্সনের বিখ্যাত বই ‘সাইলেন্ট স্প্রিং’ এর মতো নীরব বসন্ত যেন পৃথিবীতে বিরাজ না করে রাসায়নিক কৃষির দৌলতে। এমন কৃষি চাই না যেখানে ফলের গাছে পাখির কূজন না শুনি, এমন কৃষির প্রয়োজন নেই যেখানে ধরিত্রী বন্ধ্যা হয়ে ওঠে। রঙবেরঙের প্রজাপতি হারিয়ে যাবে, কাঠবেড়ালির দেখা দুর্লভ হবে, নানান মেরুদণ্ডী প্রাণীর জীবন বিনষ্ট হবে — এমন কৃষি আমরা যদি না চাই তো জৈবকৃষির অভিমুখে রওনা দেব, আর তাই অর্গানিক সব্জি ও ফসল ফলিয়ে খাবো এবং খাওয়াবো।
স্বচ্ছ ভারত যদি গড়তে হয় তবে কৃষিক্ষেত্রকে বিষমুক্ত করতে হবে, আর এই যুদ্ধ কোনো রাজনৈতিক লড়াই নয়, বাঁচবার লড়াই, এই স্বচ্ছতার লড়াই-এ সকল দেশবাসীকে সামিল হতে হবে। জৈবপদ্ধতিতে চাষ করা মানে নানা উপায়ে কীট ও রোগকে এড়িয়ে চলা এবং অপ্রচলিত জৈবিক উপায়ে তাদের দমন। তাই চাষী যখন বাজারে নিজের হাতে চাষ করা খানিক-কীটদষ্ট বা তুলনামূলক নিষ্প্রভ জৈব ফসল নিয়ে আসেন তখন অনেক সময় ক্রেতার মন কাড়ে না। তবে অর্থকরীভাবে চাষ হওয়া জৈব ফসলে নিয়মিত পরিচর্যায় ও নজরে কীট ও রোগের প্রাদুর্ভাব থাকে না, ফলে উৎপাদিত সব্জি ও ফলের নির্মল নিষ্কলঙ্ক ভাব ও ঔজ্জ্বল্য বজায় থাকে।
শুধু কেনা সবজি নয়, নিজের বাড়িতে, ছাদে, বারান্দায়, আপনার কিচেন গার্ডেনে যে ফল ও সব্জি জৈবিক উপায়ে ফলাবেন তাতে খানিক কীট-দংশিত অংশ ফেলে দিলেই বা ক্ষতি কী? কারণ এ ফসল তো আপনি নিজে উৎপাদন করেছেন, দেননি কোনো সার, কীটনাশক, তাই এক দেবভোগ্য খাদ্য। সবচেয়ে বড় কথা হল অর্গানিক ফসলের গুণমানের দিকটি। তাতে ফসলের নির্ধারিত পুষ্টিমান বজায় থাকে।
সিকিমের মত রাজ্য পুরোটাই অর্গানিক স্টেট বা জৈব-ফসল উৎপাদনকারী রাজ্যে পরিণত হলেও পশ্চিমবঙ্গ এ বিষয়ে তেমন এগিয়ে নেই। যদিও দার্জিলিং ও কালিম্পং জেলার মানুষ ফসল উৎপাদনে জৈব পদ্ধতি ব্যবহার করে বেশি। তবে রাজ্যের নানা অঞ্চলের মানুষ বিক্ষিপ্তভাবে জৈব ফসল চাষ করছেন। কোথাও একসঙ্গে বেশ কিছু চাষি সমবেতভাবে চাষ করছেন, কোথাও সমবায়সমিতির মাধ্যমে, কোথাও কোনো জৈবপণ্য বিপণন সংস্থার সহায়তায়, কোথাও সরকারি উদ্যোগে, কোথাও স্বেচ্ছাসেবী প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে তারা জৈব ফসল ফলাচ্ছে। এ রাজ্যের মল বা বৃহৎ বিপণীকেন্দ্রে জৈব ফসল অধিক দামে বিক্রি হয়। কলকাতা মহানগরী সমেত বেশ কয়েকটি স্থানে জৈবহাট বসে। এছাড়া অন লাইন মার্কেটও ইদানীং ব্যাপকতা লাভ করেছে। কিছু সচেতন চাষী নিজের বাড়ির প্রয়োজনে নিজের দৈনন্দিন ফসল জৈবিকভাবে চাষ করে নিচ্ছেন। তার উদ্বৃত্ত সামগ্রী নিজের গাঁয়ে বা বাজারে নিয়ে যান। তবে জৈব সামগ্রী বেচাকেনার তেমনভাবে বাজার আজও গড়ে ওঠেনি। আমলাতান্ত্রিক সমস্যা ও দুর্নীতির অভিযোগও কোনো কোনো কৃষক ও কৃষি সংগঠন করেছেন।
শহরের মানুষ কি অর্গানিক ফসল করতে পারবেন?
শহরের বাড়ির মালিক ছাদে, বারান্দায়, জানালার খাঁচায় জৈব বাগান তৈরি করতে পারেন। এমনকি ফ্লোর মালিকও পারেন তার বারান্দা বা জানালার খোপে টবে, বস্তায় বা বোতলে মাটি রেখে তাতে নানান ফসল ফলাতে। যেমন বস্তায় হলুদ, আদা; টবে লঙ্কা, ভেন্ডি, ক্যাপসিকাম, বেগুন। এমনকি টবে লতানে সব্জি যেমন লাউ, কুমড়ো, শসা, উচ্ছে লাগিয়ে তা জানালায় বা ছাদে লতিয়ে দিতে পারেন। ছাদে সামান্য মাটি ফেলে তাতে লালশাক, কাটোয়া ডাঁটা, ধনেপাতা, পুদিনাপাতা, মেথিশাক, পাটশাক ইত্যাদি চাষ করে নিতে পারেন। অনেকে ছাদে বড় টবে মাটি রেখে আম্রপালি, মঞ্জিরা হাইব্রিড আম, বেঁটে জাতের পেয়ারা, ডালিম, করমচা, চেরি, মুসাম্বি, পাতি ও বাতাবি লেবু, সবেদা ইত্যাদি চাষ করে নিতে পারেন, কোনোরকম কেমিক্যাল ব্যবহার না করে। (লেখক বিধানচন্দ্র কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ও বিশিষ্ট প্রাবন্ধিক।)