দীপ্তাস্য যশ
আমাদের ভারত, ৯ মার্চ:
তৃণমূল-বিজেপি সেটিং নিয়ে নানা কথা শুনি, কিন্তু সেটিং-এর যেটা মূল কথা দুই পক্ষের মধ্যে স্বার্থের বিনিময়, তা নিয়ে কোন যুক্তি গ্রাহ্য ব্যাখ্যা এযাবৎ কোন সেটিং প্রবক্তাকে দিতে দেখলাম না।
রাজনীতি হোল সম্ভাবনার অঙ্ক। সাধারন অংকে দুই আর দুইয়ে চার হয়। কিন্তু রাজনীতিতে যে সবসময় দুই আর দুইয়ে চার হবে তার কোনও নিশ্চয়তা নেই। রাজনীতিতে দুই আর দুইয়ে পাঁচ-ও হতে পারে আবার দুই আর দুই যোগ করে শূণ্যও হতে পারে। ঠিক তেমনই সেটিং তখনই হয় যখন সেখানে দুই পক্ষেরই কিছু পাওয়ার সম্ভাবনা থাকে।
আচ্ছা বলুন তো বিজেপি যদি এই মুহূর্তে তৃণমূলের সাথে সেটিং করে তাহলে বিজেপির কোন স্বার্থ পূরণ করতে পারে তৃণমূল?
ভোট কেটে সুবিধা করে দেবে? কোথায়? কোন রাজ্যে? গোয়া, ত্রিপুরায়? নোটার থেকেও যারা কম ভোট পায় তারা ভোট কেটে সুবিধা করে দেবে? ভোট কেটে সুবিধা করে দিতে পারে সেই, যার নিজের কিছু অস্তিত্ব আছে। ত্রিপুরা, গোয়াতে তৃণমূলের অস্তিত্ব কোথায়? তাহলে? ভোট কেটে সুবিধা করে দেওয়ার অঙ্কটা তো ঠিক দাঁড়াচ্ছে না।
তাহলে আসা যাক দ্বিতীয় সম্ভাবনার কথায়। লোকসভা, রাজ্যসভায় এনডিএ সরকারকে বিভিন্ন বিল পাশে সুবিধা করে দেবে?
২০১৬ আর ২০২৩-এর মধ্যে অনেক তফাত। বিশেষত শিবসেনা উদ্ধব ঠাকরের হাতছাড়া হওয়ার পরে আর এখন বিজেপির কারুর সাহায্যের প্রয়োজন নেই কোনও বিল পাশ করানোর জন্য। লোকসভাতে সে প্রয়োজন অনেক আগেই মিটে গেছিল, এখন রাজ্যসভাতেও এনডিএ স্বাবলম্বী। সেই সাথে সময়ে সময়ে বিজেডি, নর্থ-ইস্টের ছোট ছোট দলগুলোর সাথে সমঝোতার অঙ্ক তো আছেই। সবাই তো আর মমতা ব্যানার্জি বা নীতিশ কুমারের মতো নিজের আওকাদ না বুঝে চলে না। কাজেই এই দলগুলো নিজেদের রাজ্যের স্বার্থের জন্য কখনই সরকারের বিরুদ্ধে যাবে না।
সবথেকে বড় প্রশ্ন হোল, তৃণমূল যদি কোনও বিল পাশ করাতে সাহায্য করবে বলে ভেবেও নিই, তাহলে কোন বিলগুলোতে সাহায্য করবে? ইউনিফর্ম সিভিল কোড? নাগরিকত্ব আইন? এনআরসি? আইএএস, আইপিএস কোড?
ঠিক কোন বিলটাতে তৃণমূল সাহায্য করবে বলে মনে হয়? এই একটি বিলেও যদি তৃণমূল কেন্দ্রীয় সরকারের বিরুদ্ধে ভোট না দেয় তাহলে তৃণমূলের আর অস্তিত্ব থাকবে?
তাহলে তৃণমূলের কাছে এক পশ্চিমবাংলার সরকার ছাড়া বিজেপিকে দেওয়ার জন্য রইল কি? শেষ অব্দি নিজের পরিবারকে বাঁচাতে সেটাই হয়ত দিয়ে দিতে হবে। কিন্তু এতো সহজে দিয়ে দেবে বলে মনে হয়? হাজার হাজার কোটি টাকার ইনকাম ব্যানার্জি পরিবার এবং তাদের ভাই ভাইপোরা ছেড়ে দেবে বলে মনে হয়?
আসলে এই সেটিং-এর গল্পটা এসেছে ফিসফ্রাই জোট থেকে। কি ভাবে? কতোগুলো তথ্য দিই নিজেরাই মিলিয়ে নিন।
ডিএ মামলা নিয়ে নাকি বামপন্থী কর্মচারী সংগঠনগুলি জোরদার লড়াই দিচ্ছে। সরকারের ভিত কাঁপিয়ে দিচ্ছে। ভালো কথা। তা সুপ্রিম কোর্টে পশ্চিমবঙ্গ সরকারের হয়ে ডিএ মামলার দেখভাল কারা করছেন? অভিষেক মনু সিংভিদের মতো কংগ্রেস নেতারা। এই রাজ্যে তো কংগ্রেস আর সিপিএমের জোটের বেশ কয়েকদিন হয়ে গেল। সদ্য ত্রিপুরাতেও দুই দল জোট করেই লড়েছিল। তা কোনওদিন দেখেছেন কোনও বামপন্থী নেতাকে প্রশ্ন তুলতে তাদের জোট সঙ্গীর প্রতি, যে কেন তাদের নেতারা তাদের স্বার্থকে ক্ষুণ্ণ করে মামলা লড়ছে?
সেদিন দেখলাম টিভিতে সিপিএমের হারের হ্যাটট্রিক করা এক “সম্ভাবনাময়” নেতা বলছেন শিক্ষায় দুর্নীতি নাকি তারাই জনসমক্ষে এনেছেন। তারাই নাকি তৃণমূলের দুর্নীতিগ্রস্ত নেতাদের জেলে পাঠাবে। খুব ভালো কথা। কিন্তু সুপ্রিম কোর্টে মানিক ভট্টাচার্য্যের সুরক্ষা কবচের মামলা কারা যেন লড়েছিল সিবিআই-এর হাত থেকে গ্রেপ্তারি এড়াতে? কংগ্রেসের সেই দিগ্বজ সর্বভারতীয় নেতারাই তো? কোনও সিপিএম নেতাকে, কোনও প্রদেশ কংগ্রেস নেতাকে দেখেছেন তা নিয়ে প্রশ্ন তুলতে?
সবথেকে বড় উদাহরণ হোল “কয়লা ভাইপোর” উদাহরণ। কয়লা ভাইপোর পুরো পরিবারের মামলা সুপ্রিম কোর্টে কে লড়ছে? কয়লা ভাইপো ছেড়ে দিন, তার বিশ্বাসভাজন, বর্তমানে পলাতক বিনয় মিশ্রের কেস কে লড়ছে? অভিষেক মনু সিংভী। তিনি কে? কংগ্রেসের সর্বভারতীয় নেতা, রাজ্যসভার সাংসদ পশ্চিমবঙ্গ থেকে তৃণমূলের সহযোগীতায়। তা কোনও বাম বা প্রদেশকংগ্রেস নেতাকে কোনওদিন দেখেছেন এই নিয়ে অভিষেক মনু সিংভীকে একবারও প্রশ্ন করতে?
আর সবথেকে বড় উদাহরণ তো অধীর চৌধুরীর মামলা। অধীর চৌধুরী লোকসভায় কংগ্রেসের বিরোধী দলনেতা। তিনি মামলা করেছিলেন পশ্চিমবঙ্গ সরকারের বিরুদ্ধে। সেই মামলায় অধীর চৌধুরীর বিরুদ্ধে কে লড়েছিলেন? আরেক সর্বভারতীয় কংগ্রেস নেতা পি চিদাম্বরম। একদিন হাইকোর্টে চ্যানেল ডেকে স্লোগানিং-এর নাটক হোল। তারপরে? একটা টুঁ শব্দ শুনেছেন কোনও বাম বা কংগ্রেস নেতার মুখে?
এমনকি এই যে কৌস্তভবাবু বিরোধিতা করতে গিয়ে জেলে গেলেন। কাল যদি এই মামলা সুপ্রিম কোর্টে ওঠে তাহলে কৌস্তভবাবুর বিরুদ্ধে রাজ্য সরকারের হয়ে দাঁড়াবেন কে? কৌস্তভবাবুর বিপক্ষ উকিলের নামটা যে অভিষেক মনু সিংভী হবে তার সম্ভাবনা একশো শতাংশ।
এবার বলবেন এটা বাম বা প্রদেশকংগ্রেসের নেতাদের অকর্মন্যতা। এর মধ্যে সেটিং কোথায়?
আজ্ঞে এটাই সেটিং। একদিকে সেটিং-এর গল্প দিয়ে তৃণমূল নিজের দলের নিচের তলা ধরে রাখার চেষ্টা চালাচ্ছে, অপরদিকে বামেরাও চেষ্টা চালাচ্ছে নিজেদের রক্তক্ষরণ আটকাতে। কারন এদের সবার শত্রু একটাই। সেটা হোল আরএসএস এবং বিজেপি।
শিক্ষায় দুর্নীতি নিয়ে নাকি বামেরা প্রচুর আন্দোলন করছে। তা করুণাময়ী থেকে যখন বঞ্চিত ছেলেমেয়েগুলোকে পুলিশ মেরে তুলে দিচ্ছিল, সেই সময় সিপিএমের ভূমিকা কী ছিল তাদের উঠতি নেত্রী মীনাক্ষীর নেতৃত্বে সে তো সেই দিনের ভিডিও দেখলেই জেনে যাবেন। আর ডিএ আন্দোলন? যারা ডিএ নিয়ে আন্দোলন করছেন তাদের প্রতি পূর্ণ সম্মান জানিয়েই প্রশ্ন করছি, ডিএ নিয়ে যা হচ্ছে বা হয়েছে তাতে আন্দোলনের ভূমিকা কতটুকু আর আদালতে মামলার ভূমিকা কতটুকু? বরং বাম কর্মচারী সংগঠন যদি সত্যিই মনে করে ডিএ তাদের হকের দাবি, তাহলে তারা আগে তাদের জোটসঙ্গীকে চাপ দিক রাজ্য সরকারকে মামলায় সহায়তা না দেওয়ার জন্য। কিন্তু তারা তা বলবে না। কারন এটাই সেটিং। এতেই স্বার্থ আছে।
কি সেই স্বার্থ?
স্বার্থ এটাই, শূন্য হয়ে যাওয়া সিপিএমকে প্রাসঙ্গিক করে রাখা যাতে বিরোধী ভোটকে ভাগ করা যায়। ২০২১ সালেই আমরা দেখেছি মূল বিরোধী দলের ভোট দুই শতাংশও কমলে শাসক দলের কীভাবে লাভ হতে পারে। আর যদি সেই বিরোধী ভোটকে আরও একটু ভাগ করে দেওয়া যায় তাহলে তাতে একদিকে লাভ শাসক দলের। অপরদিকে লাভ সেই বিরোধী দলগুলির যাদের প্রাসঙ্গিকতা শূন্য হয়ে গেছে। তারা তাহলে আবার কিছু আসন পেয়ে নিজেদের প্রাসঙ্গিকতা ফিরে পাবে। আর এই রাজ্যের কংগ্রেস সিপিএম ‘৭৭ সাল থেকেই এরকম ফিসফ্রাই জোটে অভ্যস্ত। স্বর্গীয় গণিখান চৌধুরী তার ভুক্তভোগী।
কোনও কোনও “বিশেষ অজ্ঞ” অবশ্য বলেন যে লোকসভাতে নাকি বিজেপিকে তৃণমূল নিজের সিট ছেড়ে দেবে এটাই সেটিং। সাগরদিঘী তো দেখিয়ে দিল যে দলটার সংখ্যাঘুঘু ১৫% মতো কমে গেলেই অবস্থা চিত্তির। এবার ভাবুন যে সিটগুলোতে হিন্দুরা মেজরিটি আর সংখ্যাঘুঘু ভোট ২০-৩০% মতো সেখানে যদি ১০% ভোটও ভেঙে যায় তাহলে তৃণমূলের অবস্থাটা কি হতে পারে? এরকম আসনের সংখ্যা কিন্তু প্রায় দশ। এবার আপনার মনে হয় সেটিং করে তৃণমূল লোকসভায় সিঙ্গেল ডিজিটে নেমে আসতে চাইবে? তাহলে কি সেই সরকারটাই দিয়ে দেওয়া হোল না?
এরথেকে বরং তৃণমূলের কাছে পছন্দের হবে, উত্তরবঙ্গ এবং জঙ্গলমহলে সিপিএমকে বিধানসভায় কিছু সিট “পাইয়ে” দিয়ে বিজেপির আসন সংখ্যা কমানো। কারণ তাতে করে আরও একটা টার্ম নিশ্চিত হবে। আরও কয়লা, গোরু, বালি খাওয়া যাবে।
অপরদিকে ভাবুন কেন্দ্র সরকার যদি এই দুর্নীতিগুলোর তদন্ত করে দোষীদের চাপে ফেলতে পারে তাতে বিজেপির লাভ না ক্ষতি? ভোট যেমন করানো হয়, তেমনই ভোট তো দেয়ও মানুষ। শুধু ভোট করিয়ে লোকসভায় ১৮ টা আসন পাওয়া যায়? তাহলে তো বিধানসভাও জিতে যাওয়া যেত।
এই লেখাটা অনেক আগেই লিখতে পারতাম, কিন্তু অপেক্ষা করছিলাম অনুব্রতর দিল্লি যাওয়ার মতো একটা ঘটনা ঘটার জন্য। যাতে করে উদাহরণগুলো বুঝতে সবার একটু সুবিধা হয়।
একটা জিনিষ বুঝুন, এইসব দুর্নীতিগুলোতে যারা যুক্ত, তারা প্রত্যেকেই রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব এবং যথেষ্ট প্রভাবশালী ব্যক্তিত্ব। তারা এক একদিনে কোর্টে কোটি কোটি টাকা খরচ করছে নিজেদের বাঁচানোর জন্য। সেই সাথে এদের হাতে আছে এমন একটি রাজনৈতিক দলের নেতৃত্ব যারা নিজেদের স্বার্থসিদ্ধির জন্য চূড়ান্ত অরাজকতা তৈরি করতে কোনও দ্বিধা করে না। মনে করুন সিএএ বিরোধী আন্দোলনের কথা। কাজেই এদের বিরুদ্ধে প্রতিটি আইনি পদক্ষেপের সাথে সাথে রাজনৈতিক অঙ্কও ওতোপ্রোতভাবে জড়িত থাকবে। বিশেষত যখন জর্জ সোরোসের মতো লোকেরা হাজার হাজার কোটি টাকা খরচা করছে আমাদের দেশে অরাজকতা তৈরি করার জন্য।
হ্যাঁ, নিশ্চিত থাকুন, এরা কেউই বাচবে না। একটা গেছে, আরও অনেকেই যাবে এবং যারা যাবে তারা কেউই চট করে আর বেরোবে না। কেউ কেউ হয়ত আর বেরোবেই না। আর যে কয়েকটা বেরিয়ে এসে সাপের পাঁচ পা দেখেছিল, সেগুলোও আবার যাবে। ছাড় কেউই পাবে না। সময়ে সবাই এক এক করে তিহাড়ের রাজমা চাউল খাবে ঠিকই।
এরপরেও যদি সন্দেহ থাকে তাহলে ২০১৬ থেকে ২০২১ বিরোধী দল হিসাবে কংগ্রেস বা সিপিএমের ভূমিকার সাথে ২০২১ থেকে এযাবৎ বিরোধী দল হিসাবে বিজেপির ভূমিকার তুলনা করুন। মনে রাখবেন সিপিএমের মিটিং-এর পরে কিন্তু কেউ উত্তেজিত হয়ে “কপালে গুলি করার” কথা বলে ফেলে না।
আর তৃণমূলি ভাইদের বলছি, আপনারা পরিস্থিতির শিকার, আপনারা নেতাদের কথা শুনে আরও বিপদে মধ্যে জড়াবেন না, মানুষের ঘৃণা আর কুড়োবেন না। কারন যে দাদা আপনাকে সেটিং বোঝাবে সেই দাদাই কবে যে টুক করে তিহাড় চলে যাবে ধরতেও পারবেন না।