সোমনাথ বরাট, আমাদের ভারত, বাঁকুড়া, ২০অক্টোবর: কার্তিক অমাবস্যার রাতে মা কালীর আরাধনায় যখন সকলেই মেতে থাকেন তখন বাঁকুড়ার গ্রামে ঘটা করে আরাধনা করা হয় মহাসরস্বতীর। দ্বারকেশ্বর নদীর তীরে কালাবতী গ্রামে প্রতি বছর দীপান্বিতা অমাবস্যার রাতে এই মহাসরস্বতীর পূজা হয়ে থাকে। এই পূজা বিরল।বর্তমানে এই পূজা ট্রাস্টি বোর্ড দ্বারা পরিচালিত হয়।
কথিত আছে যে গ্রামের চৌধুরী পরিবারের এক পূর্বপুরুষ বিন্ধ্যাচল পর্বতে তপস্যা করতে গিয়েছিলেন। সেখানে তিনি দেবী সরস্বতীর স্বপ্নাদেশ পান। দেবী তাকে বলেন,নিজের গ্রামে ফিরে এসে মহাসরস্বতী রূপে তার পূজা শুরু করতে। গ্রামে ফিরে সেই সাধক এই পূজার সূচনা করেন। পরবর্তীতে তিনি ব্রজভূমিতে চলে যাওয়ার সময় পূজার দায়িত্ব তিন ভাইয়ের হাতে দিয়ে যান। এখনও প্রাচীন রীতি মেনে সেই পূজা হয়ে আসছে। এলাকাবাসীদের মনে এই পূজার আলাদা একটা আকর্ষন আছে। কালীপূজার দিন এলাকাবাসীদের আবেগ লক্ষ্য করা যায়। এখনও সেই চৌধুরী পরিবারই পূজার মূল আয়োজক হলেও তা একটি ট্রাস্টি বোর্ড পরিচালনা করে। এই দেবী মহাসরস্বতী অষ্টভূজা ও সিংহের ওপর উপবিষ্টা। তাঁর বাঁ পায়ের নীচে রয়েছে অসুর, দু’পাশে ডাকিনী ও যোগিনী। দেবীর সঙ্গে আছেন ব্রহ্মা, বিষ্ণু, মহেশ্বর এবং গণেশ ও দুই সখী। এই প্রতিমার সৌন্দর্য ও মহাশক্তির ভাব ভক্তদের মুগ্ধ করে।
প্রথমদিকে এখানে মাটির প্রতিমা তৈরি করা হত।এখন তৈরী হয়েছে স্থায়ী পাথরের মূর্তি। তবে প্রথা অনুযায়ী প্রতি বছর সেই পাথরের মূর্তিতেও “মাটি ছোঁয়ানো” হয়। প্রাচীন রীতি মেনে এই দায়িত্ব বড়জোড়ার এক নির্দিষ্ট পরিবারের ওপরই রয়েছে। দীপান্বিতা অমাবস্যা বা কালীপূজার মধ্যরাতের আগে পুজো শুরু হয় এবং চলে ভোরবেলা পর্যন্ত। প্রাচীন রীতি মেনে পরদিন সকালে হয় পুষ্পাঞ্জলি ও নরনারায়ণ সেবা। গ্রামের প্রতিটি পরিবার অংশ নেয়। এই পুজোয় আগে পশুবলি প্রচলিত ছিল, কিন্তু ২০২১ সালে পাথরের মূর্তি হওয়ার পর থেকে সেই প্রথা বন্ধ করা হয়েছে। তারপরিবর্তে চালকুমড়ো, আখ, কলা ইত্যাদি প্রতীকী বলি দেওয়া হয়।
এই পূজায় দেওয়া হয় খিচুড়ি প্রসাদ। গ্রামের সবাই আর্থিক সহায়তা করে হাজার হাজার ভক্তের জন্য প্রসাদ তৈরি করেন। ভোরবেলায় ভক্তরা দেবীর আরাধনা শেষে প্রসাদ গ্রহণ করেন। দূরদূরান্ত থেকে মানুষ আসেন এই ব্যতিক্রমী পূজা দেখতে। সারারাত ধরে চলে যাত্রা, কীর্তন সহ সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। প্রতিদিন সন্ধ্যায় গ্রামের মানুষ মহাসরস্বতী মন্দিরে এসে প্রণাম করেন। তাদের বিশ্বাস দেবীর কৃপায় এই গ্রামে কোনো বড় বিপদ ঘটেনি আর ঘটবেও না। মহাসরস্বতীর কৃপায় গ্রামে শান্তি, শিক্ষা ও সমৃদ্ধি রয়েছে। গ্রাম উন্নয়নের পথে এগিয়ে চলছে।
পূজার এই আয়োজনেই গ্রামের ঐক্য ও সংস্কৃতির ছাপ স্পষ্ট ফুটে উঠে।

