আমাদের ভারত, রামপুরহাট, ২ জানুয়ারি: ফুল কড়ি, দুধ কড়ি, তিল কড়ি, বুজ কড়ি, কালো কড়ি, শ্বেত কড়ি ও শঙ্খ ঝিনুক সহ বিভিন্ন ধরনের কড়ির পসরা বসেছে বীরভূমের মল্লারপুর থানার ঘোষগ্রামে। এক সময় এই কড়ি দিয়েই কেনা বেচার রেওয়াজ ছিল গ্রামগঞ্জে। সেই শুভঙ্কর পদ্ধতি এখন অবলুপ্ত। তেমন দেখা মেলে না ‘কড়ি’রও। তবে ঘোষগ্রামের মেলায় গেলেই মিলবে কড়ি। তাই একে কড়ির মেলা বলে অনেকে। পৌষ মাসের প্রতি বৃহস্পতিবার বসে এই মেলা। এদিন ছিল পৌষ মাসের তৃতীয় বৃহস্পতিবার। ফলে এদিন মানুষের উপচে পড়া ভিড় লক্ষ্য করা গিয়েছে। হাজার হাজার মানুষ ঘোষগ্রামের লক্ষ্মী মাতা মন্দিরে এদিন পুজো দেন।
পশ্চিমবঙ্গের মধ্যে একমাত্র এই গ্রামেই পৌষ মাসের প্রত্যেক বৃহস্পতিবার লক্ষ্মী পুজো উপলক্ষ্যে বসে হরেক কিসিমের কড়ির মেলা। যত দিন গড়াচ্ছে ততই এই মেলা খ্যাতি লাভ করছে। মেলায় এসে গ্রামের সেই কড়ির ছবি মনের ক্যানভাসে ফুটে উঠেছে অনেকের।
মন্দির কমিটির সেবাইত গুরুশরণ বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, “আগে কড়ির বিনিময়ে ধান কেনাবেচা চলত। টাকা পয়সা চালু হওয়ার পর কড়ি বিলুপ্তির পথে। তাই কড়িকে বাঁচিয়ে রাখতে অনাদিকাল থেকে এই মেলা হয়ে আসছে। গ্রামগঞ্জের মানুষ পুজোর পাশাপাশি কড়ির টানে এখানে ছুটে আসেন। কারণ এই মেলাতেই বিভিন্ন ধরনে কড়ি পাওয়া যায়। এখান থেকে মানুষ কড়ি কিনে নিয়ে গিয়ে বাড়ির লক্ষ্মী মন্দিরে প্রতিষ্ঠা করেন। মানুষের বিয়েতেও যে কড়ি লাগে সেই কড়ি এই মেলা থেকে কিনে নিয়ে যান অনেকে। তাই এই মেলা অনেকের কাছে কড়ি মেলা নামে পরিচিত। যতদিন যাচ্ছে এই মেলায় ততই ভিড় বাড়ছে। লক্ষ্মীর গ্রাম হিসাবে পরিচিতি লাভ করেছে ঘোষগ্রাম”।
কথিত আছে, হর্ষবর্ধনের আমলে পরিব্রাজক সাধক কামদেব ব্রহ্মচারী পরিভ্রমন করেছিলেন মায়ের সাধনার সন্ধানে। বীরভূমের রাঢ় অঞ্চল ঘুরতে ঘুরতে তিনি ঘোষগ্রামে এসে পৌঁছন। সেখানে তিনি স্বপ্ন দেখেন ক্রেতাযুগে রাম, লক্ষ্মণ, সীতা ও হনুমান বসবাসের জন্য কিছুদিন এই গ্রামে বিচরণ করে গিয়েছেন। আবার দুর্যোধনের চক্রান্তের শিকার হয়ে পান্ডবরা কিছুদিন এই এলাকায় অজ্ঞাতবাসে ছিলেন। সাধনার উপযুক্ত স্থল হিসাবে এই গ্রামের একটি নিম গাছের তলাতে তিনি সাধনা শুরু করেন। দীর্ঘদিন কঠোর সাধনার পর লক্ষ্মীর স্বপ্নাদেশ পান তিনি। তাঁকে মা স্বপ্ন দিয়ে বলেন, এই নিমগাছের তলাতেই আমার দারুময়ী মূর্তি প্রতিষ্ঠা করে পুজোর ব্যবস্থা কর। তোকে সাহায্য করবে গ্রামের দয়াল ঘোষ। এরপরই একদিন কৃষি কাজের জন্য মাঠে যান দয়াল। সেই সময় গ্রামের কাঁদরে একটি শ্বেতপদ্ম ভাসতে দেখে সেটি তুলতে গিয়ে ব্যর্থ হয়ে ফিরতে হয় দয়ালকে। রাতে স্বপ্নাদেশ পান কোন সাধক পুরুষ শ্বেতপদ্মটি তুলতে পারবে। দয়াল ছুটে যায় কামদেব ব্রহ্মচারীর কাছে। এরপরই কাঁদর থেকে শ্রেতপদ্ম ও একটি কাঠের খণ্ড তুলে নিয়ে এসে গঙ্গামাটির প্রলেপ দিয়ে লক্ষ্মীর প্রাণ প্রতিষ্ঠা করে পুজোর সূচনা করেন। সেই থেকে এই গ্রামে আরাধ্যদেবী রুপে পুজিত হয়ে আসছেন মা লক্ষ্মী। পৌষ মাসের প্রতি বৃহস্পতিবার এই মন্দিরে হাজার হাজার ভক্তর সমাগম হয়। বসে কড়ি মেলা। সম্প্রতি ১ কোটি ৪০ লক্ষ টাকা ব্যয়ে মন্দিরটি নবরূপ পেয়েছে। সেই মন্দির চত্বরেই এবার বসেছে মেলা।
এদিন ভক্তরা নতুন ধানের অন্ন দিয়ে মাকে পুজো নিবেদন করেন। ফেরার পথে সকলে কড়ি কিনে বাড়ি ফেরেন। সকাল থেকে সন্ধ্যে পর্যন্ত এই মেলা চলে। কয়েক দশক ধরে মেলায় কড়ি নিয়ে আসছেন মুর্শিদাবাদের কান্দির গৌতম দে, দীনবন্ধু দাস। তারা বলেন, “এখানে রয়েছেন মা লক্ষ্মী। তাই পূর্বপুরুষ ধরে এখানে কড়ি নিয়ে আসি। বহু মানুষ কড়ি কিনে নিয়ে যান”।