অরিত্র ঘোষ দস্তিদার এবং কল্যাণ চক্রবর্তী,
আমাদের ভারত, ৩০ অক্টোবর:
ওরা মন্দির ভেঙ্গে দিল। হয়তো কোনারকের সূর্য মন্দিরের মতো তাদেরও সূর্যদেবকে উপাসনার মন্দির ছিল। যেখানে চার দেওয়ালের মধ্যে শীত-গ্রীষ্ম-বর্ষায় তারা দেবতার নৈবেদ্য সাজাতে আসতেন। সে মন্দির ওরা শুধু গুঁড়োলোই না, গুঁড়োলো নারীর ইজ্জত। তবুও তাদের সূর্য উপাসনা থামলো না। তবুও না। তাদের মায়েরা দিনের আলো ফোটার আগে রাত থাকতেই অর্ঘ্য নিয়ে যেতেন লুকিয়ে, সূর্য ডোবার বেলায়, যখন বিধর্মী দস্যুরা অত্যাচার করে ফিরে যেতো তাঁবুতে, তখন সরাসরি সূর্যের পানে চাইতে পারতেন মা বোনেরা। নদীতে নেমে শোভাযাত্রার গল্প তখন নেই। আক্রমণ নেমে যাতে না আসে, তাই বাড়ির কাছেই পুষ্করিণীতে উষা বা সায়াহ্নের আলো-আঁধারিতে ধর্মীয় আচার পালন করে ফিরে আসতে হত। যাতে টের না পায় বিধর্মী কসাইয়েরা!
কত ভাঙবি, ভাঙ্গ! কত মন্দির গুঁড়োবি তোরা, গুঁড়ো! তারা সরাসরি সূর্যের পানে চাইবে। সূর্যকে ভাঙবি? সূর্যের আলোকে আটকাবি?
সরাসরি জবাকুসুম-সম নব-বলার্ককেই বিশেষ অর্ঘ্যে তাঁরা সাজালেন। তাদের মন্দির নেই, তাদের পুরোহিত নেই, তাদের ইজ্জতও নেই। কিন্তু এই নেই সাম্রাজ্যেও ছিল তাদের প্রিয়তম দেবতা, পৃথিবীর সমস্ত শক্তির উৎস সূর্য এবং মাতৃদেবতা উষা। ছট্ এবং ছটি মাইয়া। রোজ রোজ তিনি তাদের প্রভাতে জাগিয়ে ভগ্ন হৃদয়কে আবারও আলোকিত করলেন, আবারও সনাতনী বোধে আলোয় আলোয় উচ্ছ্বসিত করে তুললেন। এই ছট্পূজা হয়তো সেই অনুষঙ্গেই চলছে। হিন্দুত্বের অস্মিতায়, হিন্দু হওয়ার গর্বে।
যারা হিন্দুদের মূর্তি ভাঙ্গায় অভ্যস্ত, যারা মূর্তিপূজার বিরোধী, পুতুলপুজোকে অস্বীকার করেন, তারা কি ছট্পূজায় সায় দেবেন? যতদূর জানি এই পূজায় মূর্তি নেই কোনো, নির্বিকল্প প্রকৃতি উপাসনার একটি ঐতিহ্য মণ্ডিত অধ্যায়। সংস্কৃত ‘ষষ্ঠী’ কথাটি থেকে ‘ছট্’ কথাটি এসেছে। এর অর্থ হল ছয়। কার্তিক শুক্লা ষষ্ঠী তিথিতে এই উপাসনা৷ সূর্যের উপাসনা এবং সূর্যের সহধর্মিণী উষা বা ছটি মায়ের আরাধনা।
ভারতের কয়েকটি রাজ্য যেমন বিহার, ঝাড়খণ্ড, উত্তরপ্রদেশ এবং নেপালের মাধেশ অঞ্চলে ছট্পূজার আয়োজন খুব ঔজ্জ্বল্যের সঙ্গে সম্পন্ন হয়। এই অঞ্চলের মানুষ নানান জায়গায় ছড়িয়ে পড়ার সঙ্গে সঙ্গে, ছট্পূজার আয়োজনও ছড়িয়ে গেলো ভারত ও বিশ্বের নানান জায়গায়।
পরিবেশবিদেরা বলে থাকেন এই পুজো পরিবেশ-বান্ধব, প্লাস্টিকের ব্যবহার নেই, নেই ক্ষতিকারক রঙের ব্যবহার, জলে প্রতিমা বিসর্জনের ব্যাপারও নেই। তাই পরিবেশ প্রকৃতি দূষণের সম্ভাবনাও নেই।
সূর্য আমাদের সমস্ত শক্তির উৎস। প্রভাতে ও সায়াহ্নে সূর্য বন্দনার মধ্যে রয়েছে আলট্রাভায়োলেট রশ্মিমুক্ত সূর্যালোক যা দেহমন্দিরের মধ্যে সমন্বয় করানোর প্রয়াস। ছট্পূজায় সকাল-সন্ধ্যেতে পুস্করিণীর ধারে ধর্মীয় কৃত্যের মধ্যে প্রতীয়মান হয় আলো, জল ও সালোকসংশ্লেষণ প্রক্রিয়ায় গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। তাই সূর্যদেবকে সস্ত্রীক ধন্যবাদ জ্ঞাপনই এই পূজার মূল বিবেচ্য। আমরা প্রকৃতিকে নিয়েই বাঁচবো, সূর্যসম্ভব দেবতা আমাদের নিরন্তর আশীর্বাদ করুন, এই বিশ্বাসে, এই ভরসায়।

ছবি: তীর্থরাজ রায়।
ছট্পূজার ডালিতে কি থাকে? থাকে কৃষিপণ্য, যা প্রকৃতির আশীর্বাদ, যা দেবতার উদ্দেশ্যে উৎসর্গিত নৈবেদ্য যেন। সধবা নারী বাঁশের কুলোয় সূর্যের পানে সাজিয়ে ধরেন এক টুকরো খোসাসমেত আখ, পরিছন্ন করে রাখা মূলাগাছ, গোটা নারকেল, বাতাবি লেবুর গোটা ফল, পাকা কলার একটি ছড়া এবং আলাদাভাবে পুষ্টকলার কাঁদি, থেকুয়া মিষ্টি, কিছু ফুল ইত্যাদি। কমলা রঙে রঙিন সিঁদূরের পবিত্র চিহ্ন এঁকে দেওয়া হয় ডালার মধ্যস্থ ফলের গায়ে। যেন তোমারই প্রদত্ত ফসলের আশীর্বাদ তোমাকেই উৎসর্গ করলাম শ্রদ্ধায়, ভালোবাসায়, কৃতজ্ঞতায়। যেন গঙ্গাজলে গঙ্গাপূজা সম্পন্ন হল। ছট্পূজা প্রকৃত অর্থেই একটি কৃষি-কেন্দ্রিক প্রকৃতি পুজো।

(ছবি এঁকেছেন শীর্ষ আচার্য)

