শ্রীরূপা চক্রবর্তী, আমাদের ভারত, ৩০ মে: ছিপছিপে বছর ১৫-র হতদরিদ্র আদিবাসী একটা মেয়ে চাঁদমনি হেমব্রম। কদিন আগেই তার গলায় রবিঠাকুরের “সখী ভাবনা কাহারে বলে” আর নেহা কক্করের “ও হামসফর” গান দুটি সোশ্যাল মিডিয়ায় ব্যাপক ভাইরাল হয়। ওই কিশোরীর গান গাওয়ার অনায়াস ভঙ্গি প্রশংসা পায় নেটিজেনদের কাছে। হুগলির শিক্ষক শ্যাম হাঁসদা ও দুর্গাপুরের শিক্ষক চিরঞ্জিত ধীবরে ফেসবুক পেজ থেকে ব্যপক প্রচার পায় চাঁদমনির গান। গানটি শেয়ার হতে হতে পৌঁছে যায় বলিউডের বেশ কিছু নামীদামি ব্যাক্তিদের কাছে। আর এরপরই চাঁদমনির কাছে সুযোগ চলে আসে বলিউডে গান গাইবার। মাটির দাওয়ায় বসে সুরের ঢেউ তোলা চাঁদমনির দু-চোখ ভরা স্বপ্ন সফল করতে ময়দানে নেমে পড়েন দুই শিক্ষক শ্যাম হাঁসদা ও চিরঞ্জিত ধীবর।
ত্রাণ বিলি করতে গিয়ে প্রান্তিক পরিবারের ওই কিশোরীর গান রেকর্ড করেছিলেন শ্যাম হাঁসদা।
এখন এই দুঃস্থ প্রতিভাবান আদিবাসী কিশোরীকে গান তোলানো থেকে শুরু করে আর্থিক সহায়তা সব কিছুতেই শ্যাম হাঁসদার টিম তাকে সাহায্য করছে। এই টিমেরই এক সদস্য সাঁওতালি গায়ক মহেশ হাঁসদা চাঁদমনিকে গানের তালিম দিচ্ছেন ।
অন্যদিকে দুর্গাপুরের শিক্ষক চিরঞ্জিত ধীবরও চাঁদমনিকে সাহায্যের জন্য এগিয়ে এসেছেন প্রথম থেকেই। তার একটি জনপ্রিয় ফেসবুক পেজ রয়েছে। সেখান থেকেই চাঁদমনির গান ভাইরাল করা হয়ে যায়। প্রায় ১০ লক্ষের উপর মানুষের কাছে পৌছায় চাঁদমনির গান।
এই পোষ্ট দেখেই বলিউডের একাধিক শিল্পী চাঁদমনির যোগাযোগ করতে উদ্যোগী হন বলে জানান চিরঞ্জিত বাবু। পঞ্জাবের জনপ্রিয় শিল্পী অ্যায়েশান আদ্রির হাত ধরেই চাঁদমনি প্রথম বলিউড দুনিয়ায় প্রবেশের সুযোগ পায়। “জুদাইয়া বে” গানটি চাঁদমনির গলায় প্রথম রিলিজ হতে চলেছে। গানটির মিউজিক কম্পোজ করেছেন শিল্পী অ্যায়শান আদ্রি। গানটি লিখেছেন আরবান স্বরাজ। গানটির প্রযোজক আমেদাবাদের “থ্ট পেণ্টর্স সংস্থার হেমন্ত রাজপুত ও জাভেদ লাকি খান । শুক্রবার চাঁদমনি এই গান রেকর্ড করেছে। এই গান তার ভবিষ্যতের মোড় ঘুরিয়ে দিতে পারে বলে আশাবাদী দুই শিক্ষক চিরঞ্জিত ধীবর ও শ্যাম হাঁসদা। লক ডাউন উঠলে পাঞ্জাবে এই গানের ভিডিও শুট হবার কথা ।
এই গানটি রিলিজ করা ছাড়াও, জনপ্রিয় টেলি-শো ইন্ডিয়ান আইডল সিজন ১২-তে অংশগ্রহণের সুযোগ এসেছে চাঁদমনির কাছে। সেই সুযোগও চিরঞ্জিত বাবুর মাধ্যমেই তার কাছে পৌঁছায়। সবকিছু ঠিকঠাক চললে খুব তাড়াতাড়ি টিভির পর্দায় দেখতেও পাওয়া যাবে এই প্রতিভাবান আদিবাসী মেয়েটিকে ।
হুগলীর ইটাচুনা গ্রাম পঞ্চায়েত অন্তর্গত মুল্টি গ্রামের এক দিকে দশটি আদিবাসী পরিবারের বাস। তারই একটি পরিবার চাঁদমণির। তিন বোনের মধ্যে সেই বড়। স্থানীয় সারদেশ্বরী কন্যা বিদ্যাপীঠের দশম শ্রেণির ছাত্রী সে। দশ বছর আগে যক্ষ্মায় ভুগে মারা গিয়েছেন চাঁদমণির বাবা চুনু হেমব্রম। তারপর থেকে পরিবারের হাল ধরেছেন মা মালতি। মায়ের সঙ্গে মাঠে ধান রোয়া, ধান কাটা সহ সব কাজের সঙ্গী চাঁদমণি। নাহলে তো দু’বেলা দু মুঠো জুটবে না। লকডাউনের কারণে কষ্ট আরও বেড়েছিল। এইসময় এক আত্মীয়ের বাড়িতে কোনো মতে একবেলা খাবার জোটে তাদের। তার উপর আবার আমফানে মাথা গোঁজার ঘরটাও বেশ ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে।
কিন্তু শত কষ্টের মধ্যেও গান গাওয়ার ইচ্ছেটা মরেনি চাঁদমনির। এই অবস্থায় সেভাবে তালিম নেওয়ার সুযোগ না থাকায় পাশের বাড়িতে এক দাদুর মিউজিক সিস্টেমে গান শোনাই তার আপাতত সঙ্গীত চর্চার পথ। তবে অ্যায়শান আদ্রির কম্পোজ করা গান যদি হিট করে যায় তাহলে ঘুরে দাঁড়াতে পারবে চাঁদমনি আর তার পরিবার। আর তাদের জীবনের চাকা ঘোরানোর জন্য এই দুই শিক্ষককে কৃতজ্ঞতা জানিয়েছেন গ্রামের মানুষ। নেটিজেনদের প্রশংসাও কুড়িয়েছেন ওই দুই শিক্ষক।