ড. কল্যাণ চক্রবর্তী
আমাদের ভারত, ৪ ফেব্রুয়ারি: কয়েক বছর আগে হোয়াটসঅ্যাপে সড়গড় হতেই, নানা গ্রুপে বিজ্ঞাপন দিলাম। বোসন গল্প লিখুন। ৪ শব্দের মধ্যে। আগামীকাল রাতের মধ্যে লিখে পাঠান। তলায় নিজের পুরো নাম লিখুন।
একটি নমুনা দিই:
তুমি। তুমিই ! আমি? কল্যাণ চক্রবর্তী।
এবার বলি, গল্পে কি কি থাকে। ঘটনা প্রবাহ এবং পরিণতি। যেহেতু মাত্র ৪টি শব্দের মধ্যে বোসন – গল্পটি লিখতে হবে এবং খুব ছোট্ট করে ক্লাইমেক্সও আনতে হবে, কাজেই প্রতিটি শব্দই এখানে গুরুত্বপূর্ণ। এই ধরণের গল্পে যতি চিহ্নর ব্যবহার খুব গুরুত্বপূর্ণ এবং সুচারু হওয়া দরকার। আর দেখতে হবে যেন রয়ে যায়– ‘শেষ হইয়াও না হইল শেষ’ অথবা ‘নিঃশেষে শেষ'(Happy Ending)।
উদাহরণের গল্পে – “তুমি। তুমিই ! আমি?”
এখানে “তুমি।” = A symbolic description of one character. আমার ‘তুমি’র পরিচয়, তার স্বরূপ, সেই ‘তুমি’র সাথে আমার সম্পর্ক। আমাদের অনেক না বলা কথা, ঘটনা।
“তুমিই ! “= Your last activity towards me. এমনটি তুমি কি করে করতে পারলে?
“আমি?” = My fate. আমি তবে এখন তোমার কে? কোথায় যাব আমি? তোমার নতুন ‘তুমি’র ইঙ্গিত।
হ্যাঁ, এভাবেই লিখে ফেলুন মাত্র ৪ টি শব্দের মধ্যে। বোসন গল্প। বোসন গল্প। বোসন গল্প।
এবার বলি, বোসন গল্পের সংজ্ঞা, স্বরূপ, বৈশিষ্ট্য ; কেন বোসন গল্পের অবতারণা! বোসন- গল্পের সন্ধানে যাই এবার।
(১) বাঙালী কণা-পদার্থবিদ ড. সত্যেন্দ্রনাথ বসুর নাম থেকেই ‘বোসন’ কণার নামকরণ। কোয়ান্টাম পরিসংখ্যানের ভিত্তি রচনা করেছিলেন তিনি যা আইনস্টাইনের দ্বারা সারা বিশ্বে মান্যতা পেয়েছিল। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনার সময়ে তাঁর লালিত তত্ত্ব প্রকাশিত হয়েছিল জার্মানীর Zeitschrift fur ফ্যসিক পত্রিকায়। প্ল্যাঙ্ক-বিকিরণ তত্ত্বের ব্যাখ্যায় তিনি জন্ম দিয়েছিলেন নব উদ্ভাবিত সংখ্যায়ন — Bose-Einstein Statistics। যে সমস্ত কণিকা এই Statistics মেনে চলে তারাই হল ‘বোসন’।
(২) সাম্প্রতিক কালে ফ্রান্স- সুইডিশ সীমান্তে সার্ণের Large Hadron Collider ল্যাবরেটরির গবেষণা সমগ্র পৃথিবীর নজর কেড়েছে। বিশ্বের ১০০টি দেশের ১০০০ বিজ্ঞানী – ইঞ্জিনিয়ার মিলে তৈরি করেছেন মাটির ১৭৫ মিটার নীচুতে ৫৪ মাইল পরিধি বিশিষ্ট সুড়ঙ্গ। উদ্দেশ্য, পদার্থবিজ্ঞানের বিভিন্ন সূত্র ও অনুমানের প্রমাণ পাওয়া, মহাবিশ্বের উৎপত্তি এবং বোসন-কণার অস্তিত্ব আবিষ্কার।
(৩) বিজ্ঞানীরা আশা প্রকাশ করেছেন তাঁরা শীঘ্রই বোসন কণার একটি প্রকার তথা পদার্থবিজ্ঞানের স্ট্যান্ডার্ড মডেলের প্রস্তাবিত মৌলিক কণা Higgs Boson/ Higgs Particle/ God Particle-এর স্বরূপ সন্ধান ও আবিষ্কার করে ফেলবেন, যা বিজ্ঞানের অনেক জটিল সমস্যার সমাধান করে দেবে। এই ঈশ্বর-কণা ( আসলে ঈশ্বর-নিকুচি কণা, Goddamn Particle) -র নেই ঘুর্ণন, ইলেক্ট্রিক চার্জ, বর্ণ পরিবর্তন। এটি ভরযুক্তকরণ কণা, ভর দান করাই এর কাজ। এরা না থাকলে কণা হবে ভারহীন। এ এক রহস্যময় সৃজণের গল্প।
(৪) বোসন কণা কবি-সাহিত্যিক-গল্পকারদের মনেও বাসা বেধেছে। বোসনের সূক্ষ্মতা, রহস্যময়তা আছে বলেই তাঁরা সৃষ্টির রসদ জোগাতে পারেন। নিছক শব্দের নাড়াচাড়ায় তাদের কারিগরীতে জন্ম নেয় সাহিত্যের পুষ্প-পল্লব। সাহিত্যিকদের মনোভূমির এই একক যদি না থাকত, তবে দেখতাম শব্দের লাশকাটা শরীর — নির্ভার, নির্জলা, নিরাভরণ সত্ত্বা। আমরা মনে করি, বিশ্বাস করি কবি-সাহিত্যিকদের মনের গহনে গহনে, তন্ত্রীতে তন্ত্রীতে, রক্ত-জালকের শাখা-প্রশাখায় রয়েছে সাহিত্য কাঠামোর বোসন কণা। যা থেকে অবয়ব পায় পূর্ণ গল্পের শরীর।
(৫) সার্ণের গবেষণা ক্ষেত্রের মতই ফেসবুকের এই গবেষণাগারে আমরা সেই ঈশ্বর-কণার স্বরূপ সন্ধানে ব্রতী হয়েছি, সাহিত্যিকদের মনের ল্যাবরেটরিতে।
বোসন গল্পের আরো একটি উদাহরণ :
“আমি। তুমি। এবার সে।”–সুপ্রিয় রায়।
এখানে নায়ক, নায়িকা/ প্রতিনায়ক, সঙ্গে তৃতীয় সম্ভাবনা। সে কি সন্তান? সে কি ত্রিকোণ প্রেম? সে কি খলনায়ক? না কি সে মৃত্যু!
বোসন গল্পে খুব কম শব্দে বক্তব্য তুলে ধরতে হবে। তাই যতিচিহ্ন খুব কাজের হয়। তারমধ্যে গল্পের মোচড়, নিঃশেষে শেষ হওয়া অথবা শেষ হয়েও শেষ না হওয়ার উপসর্গ থাকতে হবে। “রাম শ্যাম যদু ….। মধু!” – এই বোসনে দেখুন চারটি কথায় কেমন ছোটো গল্পের অবয়ব। আহ্বানে লিখেছিলেন নিখিলেশ্বর ভট্টাচার্য। রাম-শ্যাম-যদু-মধু এই চারমূর্তির কথা পাটিগণিতে হামেশাই পাওয়া যেত বা যায়। চার ইয়ার, চার বন্ধু। ছাত্র-শিক্ষক- অভিভাবকের চার পরিচিত নাম। যখন শুরু করছি ‘রাম শ্যাম যদু …. ‘ এর পর স্বভাবতই প্রশ্ন এসে যায়, তবে মধু? মধু কি এখন বাকী বন্ধুদের থেকে আলাদা হয়েছেন? রাজনৈতিক বিতর্ক-বিবাদ হয়ে পৃথক হয়েছেন? মারা গেছেন? অথবা, রাম-শ্যাম-যদু র বন্ধুত্বের বন্ধন বা ‘মধু’ কি? অথবা তিনজন কি আলাদাভাবে ‘মধু’ নামে কাউকে চান, কোনো বিষয়ের প্রতি আলাদা দুর্নিবার আকর্ষণ বোধ করেন? এরকম হরেক প্রশ্নের জন্ম দিয়ে গেছে বোসন গল্পটি। শেষ বা সমাধান হয় না, লেখক দিয়েও যান না। আপনি স্বল্প কথায় আর যতিচিহ্নের অর্থবহ ব্যবহার করে এমন আদল দিন গল্পে। আমরা পড়বো। আর এভাবেই আজ ৪ ঠা ফেব্রুয়ারি আচার্য সত্যেন্দ্রনাথ বসুর প্রয়াণ দিবসে শ্রদ্ধা জানাবো।