Agricultural fair, Kalyani, ফল চাষ ও খাওয়ার গুরুত্ব উপলব্ধি করাতে মেলার আয়োজন করল বিধান চন্দ্র কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়

মিলন খামারিয়া, আমাদের ভারত, কল্যাণী, ৭ জুন: হরেক রকমের মেলার কথা আমরা সবাই শুনে থাকি। খাদি মেলা, খাদ্য মেলা, বিভিন্ন পুজো উপলক্ষে মেলা, বই মেলা ইত্যাদি। অন্যান্য মেলার মতো বসন্ত কালের ফুল মেলাও যথেষ্ট জনপ্রিয়। কিন্তু ফল মেলার কথা তেমন শোনা যায় না। কিন্তু এই ফল বা ফল থেকে উৎপাদিত বিভিন্ন প্রক্রিয়াজাত খাবার খেলে শরীরে ভিটামিন ও মিনারেলস গুলো যথাযথ পাওয়া যায়। কিন্তু সেই ফল নিয়ে মেলার আয়োজন করার কথা ভাবেন না তেমন কেউই।

কিন্তু বিধান চন্দ্র কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘সর্ব-ভারতীয় সমন্বিত ফল গবেষণা কেন্দ্র’ (ICAR-AICRP on Fruits, Mohanpur, Bidhan Chandra Krishi Viswavidyalaya) গত চার বছর ধরে আয়োজন করছে এমনই ‘ফল বৈচিত্র্য মেলা’র। ফল উৎপাদনে উৎসাহ দিতে এবং ফল আমাদের শরীরের জন্য কতটা উপকারী – তার গুরুত্ব বোঝাতেই বিশ্ববিদ্যালয় আয়োজন করে চলেছে এমন মেলা। গত ৫ ই জুন মন্ডৌরির ফল গবেষণা কেন্দ্রে আয়োজিত হয়েছিল এই ‘ফল বৈচিত্র্য মেলার।

নদিয়া, উত্তর ২৪ পরগনা, পূর্ব বর্ধমান, হুগলি, হাওড়া, পূর্ব মেদিনীপুর, কোচবিহার ও মুর্শিদাবাদ – মোট ৮ টা জেলা থেকে প্রায় ৫০ জন প্রগতিশীল ফল চাষী এসেছিলেন তাদের উৎপাদিত ফল নিয়ে। উন্নত জাত, দেশি, শঙ্কর ও বিদেশি জাতের ১৫০ প্রজাতির আম, নানা রকম লেবু; লাল,হলুদ ও সাদা শাস যুক্ত ড্রাগন ফল; লিচু, পেয়ারা, কলা, সবেদা, আনারস, গোলাপ জাম, কয়েতবেল, লটকা, চালতা, গাব, চেরী, ডেউয়া, করমচা প্রভৃতি মুখ্য ও গৌণ ফল রাখা হয়েছিল প্রদর্শনীর জন্য। এই সব ফলের চাহিদা দিন দিন বাড়ছে। তাই এই সব ফল চাষে উৎসাহ দিচ্ছে বিধান চন্দ্র কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়।

এই ফল বৈচিত্র্য মেলায় উপস্থিত হয়েছিলেন বিশ্ববিদ্যালয়ের ভারপ্রাপ্ত উপাচার্য অধ্যাপক শুভেন্দু বিকাশ গোস্বামী, ‘কৃষি ও উদ্যান অণুষদ’-এর অধ্যক্ষ দ্বয় অধ্যাপক পবিত্র কুমার মানি ও অধ্যাপক জীতেশ কুমার হোড় , ‘স্নাতকোত্তর অণুষদ’-এর অধ্যক্ষ অধ্যাপক শঙ্কর আচার্য, গবেষণা অধিকর্তা অধ্যাপক শুভ্র মুখার্জি এবং ফল গবেষণা প্রকল্পের বিজ্ঞানীরা (Prof. D. K. Misra, Prof. F. K. Bauri, Dr. S. Debnath, Dr. D. Majhi, Dr. A. Kar and Miss. A. Roy )।

ফল মেলার শুরুতেই প্রদীপ প্রজ্বলন করে অনুষ্ঠানের শুভ সূচনা করেন ভারপ্রাপ্ত উপাচার্য ও অন্যান্য আধিকারিক বৃন্দ।

ভারতবর্ষে ১৭৫ রকমের বুনো জাতের ফলের বৈচিত্র্য হয়েছে, তার মধ্যে ১১৭ রকমের ফলের চাষ করা হয়। কিন্তু ঘরের আঙিনায় মাত্র ২২-২৫ প্রকারের ফল স্থান পেয়েছে। তাহলে বাকি বুনো জাতের ফলকে ঘরের উঠোনে ধীরে ধীরে আনার চেষ্টা করছে বিভিন্ন কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়।

ভারতবর্ষ জীব বৈচিত্র‍্যের একটা বিরাট জায়গা। এখানে পঁয়তাল্লিশ হাজার গাছের বৈচিত্র্য রয়েছে। একানব্বই হাজার জীবজন্তুর বৈচিত্র্য রয়েছে। এখানে প্রায় বারো’শ রকমের পাখী হয়েছে। ছাব্বিশ হাজার রকমের জীববৈচিত্র্য রয়েছে আর ছয় হাজার রকমের সরীসৃপ আছে। এতো ফুলে ফলে জীববৈচিত্র‍্যে ভরা আমাদের এই ভারতবর্ষ। ‘এমন দেশটি কোথাও খুঁজে পাবে নাকো তুমি, সকল দেশের রাণী সে যে আমার জন্মভূমি’ – বলেছেন কবি,নাট্যকার ও কৃষিবিদ্‌ দ্বিজেন্দ্রলাল রায়।

এই ফল বৈচিত্র্য মেলায় উপস্থিত হয়েছিলেন অধ্যাপক শঙ্কর আচার্য। তিনি বলেন, ‘কৃষি’ কথার অর্থ হল সৃজন বা সৃষ্টি। ভাদু পরব এবং টুসু পরবে আমরা যা গান গাই তার মধ্যে প্রযুক্তির কথা বলা হয়েছে। আমাদের চর্চিত গানের মধ্যে, আমাদের চর্চিত সংস্কৃতির মধ্যে কৃষি মিলেমিশে একাকার হয়ে আছে। আধুনিক কৃষির সমস্যা হল- বিচ্ছিন্নতা। আমরা ভাবতে শুরু করলাম – আমার জন্মদিনে কোকোকোলা থাকবে কিন্তু মায়ের হাতের পায়েস থাকবে না। মায়ের হাতের রান্না করা পায়েস না থাকলে গোবিন্দভোগ চাল থাকে না। আবার গাছ-গাছালি পাখপাখালি হারিয়ে গেলে আমাদের জীবন ও সভ্যতা বিপন্নতার দিকে চলে যাবে। বটগাছ না থাকলে আমরা কার ছায়ায় দাঁড়াব? জারুল গাছের বেগুনি ফুল দেখে শুধু কবিতায় লেখা হয় না, তার ফল পাখীতেও খায়। এই পৃথিবীর নাগরিক শুধু আমরা মানুষ নই, ঐ রাঙি গাই টা, ঐ কোকিল যে গান গেয়ে যাচ্ছে, ঐ পাখীটা; ঐ প্রজাপতি যে উড়ে উড়ে ফুল ছুঁয়ে যাচ্ছে, ঐ মৌমাছি যে আমাদের জন্য খাবার বানাচ্ছে পরাগ মিলন ঘটিয়ে। সবাইকে বাঁচতে ও বাঁচাতে হবে আমাদের। সেখানেই ফল বৈচিত্র্য মেলার সার্থকতা।

অধ্যাপক দিলীপ কুমার মিশ্র বলেন, প্রায় ৫০ প্রকারের ফল আমাদের ফল গবেষণা কেন্দ্রে সংরক্ষিত রয়েছে। আম, কাঁঠাল, পেয়ারা, লিচু ও কলা – এই পাঁচটি মুখ্য ফল আমাদের গবেষণার কেন্দ্র বিন্দু হলেও সবেদা, ড্রাগন, কয়েতবেল, গোলাপ জাম, আমলকী, হরিতকী, বহেড়া, কামরাঙা, হরবরই প্রভৃতি গৌণ ও ঔষধী ফলের চাষও করা হয় এখানে।

ডিরেক্টর অফ রিসার্চ অধ্যাপক শুভ্র মুখার্জি বলেন, আমাদের শরীরের জন্য খাবারের মাধ্যমে ছ’টা উপাদান গ্রহণ করতে হয় – কার্ব-হাইড্রেড, প্রোটিন, ফ্যাট, জল, ভিটামিন ও মিনারেল। এখন ভিটামিন ও মিনারেলস পেতে গেলে ফল খেতে হবে। কার্ব-হাইড্রেড, প্রোটিন, ফ্যাট থেকে আমরা শক্তি পাই কিন্তু ফল থেকে ভিটামিন ও মিনারেলস পাই। রোগ প্রতিরোধ করার জন্য এই দু’টো উপাদান ভীষণ আবশ্যিক।

অধ্যাপক মানি বলেন, জীবন ও জীবিকার জন্য ফল চাষ ভালো জায়গা করে নিয়েছে। মুখ্য ফল – আম, লিচু, পেয়ারার পাশাপাশি গৌণ ফল আতা, ড্রাগন, অ্যাভোকাডো ইত্যাদির চাষ বাড়াতে হবে। ফলের বাজারজাত করণ যথাযথ করতে হবে। আমাদের বিধান চন্দ্র কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় গামারশ্মির সাহায্যে পাকা আমকে বেশিদিন ভালো রাখার উপায় বের করেছে গবেষণা করে। আগে যেখানে পাকা আম ৩-৪ দিনেই নষ্ট হয়ে যেত বা অধিক পেকে নষ্ট হয়ে যেত, এখন তা ১৫ দিন পর্যন্ত রাখার ব্যবস্থা করা সম্ভব হচ্ছে। তাতে বাইরের রাজ্যে বা বাইরের দেশে বিক্রি করতে অসুবিধা হবে না। পাশাপাশি ফল খেলে রোগের প্রকোপ কম থাকে। প্রাণীজ প্রোটিন নিলে ক্ষতি হচ্ছে অনেক সময়। তার বিকল্প হিসেবে ফল খেলে বেশি সুস্থ থাকা যায় তা প্রমাণিত সত্য।

অধ্যাপক জীতেশ কুমার হোড় বলেন, মেলা শব্দটির অর্থই হচ্ছে মিলন। অর্থাৎ বিভিন্ন মানুষের সমাগম ঘটে। আর এখানেও বিভিন্ন মানুষ বিভিন্ন ফলের পসরা নিয়ে হাজির হয়েছেন। এখানে বিভিন্ন ফলের আমদানি করেছেন উদ্যানপালকরা। একে অন্যের দেখে নতুন নতুন ফল চাষ তারা করবেন আশাকরি। ধান, গমের পাশাপাশি অর্থনৈতিক দিক দিয়ে স্বাবলম্বী হতে গেলে ফল চাষ করতেই হবে। ফল খাওয়ার উপকারিতা আজ প্রায় সবাই জানেন। তাই ফল চাষ করে নিজেরা স্বাবলম্বী হন এবং শরীরকে রোগমুক্ত রাখুন ফল খেয়ে।

ড. দেবলীনা মাঝি বলেন, আমাদের ফল গবেষণা কেন্দ্রতে ‘হট ওয়াটার ট্রিটমেন্ট বা গরম জল প্রক্রিয়া’র মাধ্যমে আম-কে দীর্ঘদিন ভালো রাখার পদ্ধতি আবিষ্কার করেছি। এক্ষেত্রে আম-কে প্রথমে ৫২ ডিগ্রি সেলসিয়াস উষ্ণতা যুক্ত গরম জলে ৫ মিনিট রাখতে হবে। তারপর সেখান থেকে বের করে কিছুক্ষণ ঠান্ডা জলে রেখে আম-কে ঠান্ডা করতে হবে। এরপর হাওয়ায় রেখে শুকিয়ে ফেলতে হবে। এইভাবে আম রাখলে ১০-১২ দিন পাকা আম রাখা যায়। এই প্রক্রিয়া খুব দ্রুত আমরা উদ্যানপালকদের জানানোর ব্যবস্থা গ্রহণ করছি।

ভারপ্রাপ্ত উপাচার্য অধ্যাপক শুভেন্দু বিকাশ গোস্বামী বলেন, ফল গবেষণা আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের সবচেয়ে সফল প্রোজেক্ট, যার দ্বারা প্রচুর কৃষক উপকৃত হন। করোনার পর থেকে ফলের চাহিদা ভীষণ বেড়েছে। রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়াতে ফলের বিকল্প নেই। আমাদের GDP তে কৃষির ২১-২২% অবদান থাকে আবার তার মধ্যে উদ্যানপালনের গুরুত্ব থাকে প্রায় ৩৩% এর কাছাকাছি। ধান চাষ করে লাভ হয় না কিন্তু ফল চাষ করে যথেষ্ট লাভ করছেন চাষিরা। তাই সবাইকে ফল চাষ করার জন্য বলছি আমরা।

অধ্যাপক ফটিক কুমার বাউরি বলেন, কাঁঠাল চাষের গুরুত্ব দিন দিন বাড়ছে। কাঁঠালের এঁচোড়ের চাহিদা সারা বছর থাকে। তাই ইদানিং কালে দোফলা কাঁঠাল চাষ করছেন চাষিরা আর তা চাষ করে বেশ লাভবান হচ্ছেন।

এই সার্বিক অনুষ্ঠানের সঞ্চালনায় ছিলেন ড: দেবলীনা মাঝি ও ড: অনামিকা কর এবং সহযোগিতায় ছিলেন ড: সঞ্জিত দেবনাথ ও কুমারী অঙ্কিতা রায়।

এই মেলায় উপস্থিত উদ্যানপালকদের বিভিন্ন বিভাগে – ব্যাগ, স্প্রেয়ার মেশিন, অ্যাপ্রোন ইত্যাদি দিয়ে পুরস্কৃত ও শংসাপত্র প্রদান করা হয়। এবছর ফল চাষ ও চারা কুশলী হিসাবে চাষের প্রসার ঘটানোর জন্য বিশেষ ভাবে সংবর্ধনা দেওয়া হয় নদিয়ার হরিণঘাটার উদ্যানপালক তাপস নাথকে। উপাচার্য তার হাতে পুরস্কার ও সম্মাননা পত্র তুলে দেন।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *