ভাষা দিবস উদযাপনের আড়ালে মানভূমে  বাংলা ভাষা আন্দোলন

অশোক সেনগুপ্ত
আমাদের ভারত, কলকাতা, ২০ ফেব্রুয়ারি: আন্তর্জাতিক ভাষা দিবসকে ঘিরে আলোচনার ধূম পড়েছে ভাষা আন্দোলন নিয়ে। কিন্তু তার আড়ালে চাপা পড়ে গিয়েছে মানভূমে বাংলা ভাষা আন্দোলন।

১৯১২ সালে শুরু হয় এই আন্দোলন। ১৯৪৮ থেকে ১৯৫৬ সালের মধ্যে ভাষা আন্দোলন তীব্র ভাবে ছড়িয়ে পড়ে মানভূমের বাঙালিদের মধ্যে। মানভূমের এই ভাষা আন্দোলন পৃথিবীতে ঘটা দীর্ঘতম ভাষা আন্দোলন।

১৯৫৬ সালের আগে পুরুলিয়া জেলা বিহারের অন্তর্ভুক্ত ছিল। সেই সময় রাজনৈতিক ভাবে বিহারের স্কুল-কলেজ, সরকারি দফতরে হিন্দি চাপিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করা হয়। সেই সময় জাতীয় কংগ্রেসের মাধ্যমে বাংলাভাষী জনগণ হিন্দি ভাষার বিরুদ্ধে আন্দোলন করার চেষ্টা করে; কিন্তু, বাংলা ভাষার দাবি প্রতিষ্ঠিত না হওয়ায় পুরুলিয়া কোর্টের আইনজীবী রজনীকান্ত সরকার, শরৎচন্দ্র সেন এবং  গুণেন্দ্রনাথ রায় জাতীয় কংগ্রেস ত্যাগ করে জাতীয়তাবাদী আঞ্চলিক দল লোকসেবক সঙ্ঘ গড়ে তোলেন। 

মানভূম জেলার বাংলাভাষী মানুষদের ক্ষোভ আঁচ করে জেলা কংগ্রেসের মুখপত্র মুক্তি পত্রিকায় ১৯৪৮ খ্রিষ্টাব্দের ৮ই মার্চ হিন্দী প্রচার, বাংলা ভাষাভাষীদের বিক্ষোভ ও মানভূম জেলার বঙ্গভুক্তির যৌক্তিকতা বিশ্লেষণ করে সম্পাদকীয় নিবন্ধ প্রকাশিত হল। এই বিষয়টি বিবেচনার জন্য ১৯৪৮ খ্রিষ্টাব্দের ৩০শে এপ্রিল বান্দোয়ান থানার জিতান গ্রামে অতুলচন্দ্র ঘোষের  সভাপতিত্বে জেলা কমিটির অধিবেশন হলে সেখানে প্রতিনিধিদের মধ্যে মতভেদ দেখা দেয়। ঐ বছর ৩০শে মে পুরুলিয়া শহরের অধিবেশনে মানভূমের বঙ্গভুক্তির প্রস্তাব ৫৫-৪৩ ভোটে খারিজ হয়ে গেলে অতুলচন্দ্র ঘোষ সহ সাঁইত্রিশজন জেলা কমিটি থেকে পদত্যাগ করে ১৯৪৮ খ্রিষ্টাব্দের ১৪ই জুন পাকবিড়রা গ্রামে লোক সেবক সংঘ তৈরী করেন। 

বিহার সরকার  বাংলাভাষীদের প্রতিবাদসভা ও মিছিল নিষিদ্ধ করলে  মানভূম জেলায় আন্দোলন তীব্র হয়ে ওঠে।লোক সেবক সংঘ ১৯৪৯ থেকে ১৯৫১ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত সত্যাগ্রহ আন্দোলন এবং ১৯৫৪ খ্রিষ্টাব্দের ৯ জানুয়ারি থেকে ৮ ফেব্রুয়ারি টুসু সত্যাগ্রহ আন্দোলন করে।ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি এ আন্দোলনে সক্রিয় ভাবে যোগদান করে।

হাজার হাজার বাংলাভাষী মানুষ কারাবরণ করে। এই সময় বেশ কয়েকটি টুসু সঙ্গীত জনগণের মধ্যে অত্যন্ত জনপ্রিয় হয়েছিল। তার মধ্যে একটি হল,

“শুন বিহারী ভাই
তোরা রাখতে লারবি ডাঙ দেখাই
তোরা আপন তরে ভেদ বাড়ালি
বাংলা ভাষায় দিলি ছাই৷“

বাংলা ভাষার মর্যাদা রক্ষার লড়াইয়ে সুদৃঢ় এই আন্দোলনের পর ১৯৫৬ সালে ভারত সরকার মানভূম জেলা ভেঙে পশ্চিমবঙ্গ  রাজ্যের সঙ্গে একটি নতুন জেলা (পরে পশ্চিমবঙ্গের পুরুলিয়া জেলা) সংযুক্ত করতে বাধ্য করেন।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *