বাঙালি সোজা ভাবে গণেশকে বসাতেই পারেনি

কল্যাণ গৌতম
আমাদের ভারত, ২৭ আগস্ট: ব্রিটিশ ভারতে বৈপ্লবিক সংগ্রামের আদর্শগত ভিত্তি ছিল ধর্মীয় জাতীয়তাবাদ। এই ভিত্তি দ্বিবিধ–মহারাষ্ট্রীয় আদর্শ এবং বঙ্গীয় আদর্শ। মহারাষ্ট্রীয় আদর্শে হিন্দুদের শ্রেষ্ঠ দুই ধর্মগ্রন্থ মহাভারত ও গীতা এবং লোকমান্য তিলক সৃষ্ট দুই উৎসব ‘শিবাজি উৎসব’ এবং ‘গণপতি উৎসব’ আন্দোলনের আদর্শগত ভিত্তি রচনা করিয়ে দিয়েছিল। বঙ্গীয় আদর্শে স্বামীজি ও বিবেকানন্দের শিক্ষা এবং তার সঙ্গে মহাকালী ও দেবীদুর্গা ভবানীর আরাধনা হয়ে উঠেছিল প্রেরণার উৎসস্থল।

মহারাষ্ট্রে জাতীয়তাবাদের উদ্দেশ্যে রচিত হয়েছিল ‘গণপতি-শ্লোক’, যার টেক্সটে ইংরেজ রাজের বিরুদ্ধে রয়েগেছে তীব্র সংগ্রামের মনোভাব। পূজার আছিলায় যুবসমাজ তখন টগবগ করে ফুটছে। সামনে দেবতা, পশ্চাতে দুর্দম শপথ। গণেশ পূজার মধ্যে যুক্ত হয়ে গেল ব্রিটিশ বিরোধী লড়াই। “হায়! তোমাদের দাসত্বে লজ্জা নাই? তাহা হইলে আত্মহত্যা করাই উচিত; হায়! এই কসাইরা দানবীয় নিষ্ঠুরতার সহিত গোমাতা ও গো-বৎসদের হত্যা করে; তোমরা এই যন্ত্রণা হইতে গোমাতাকে রক্ষা করিতে বদ্ধপরিকর হও; মৃত্যু বরণ কর, কিন্তু তার পূর্বে ইংরেজদের মার; অলস হইয়া বসিয়া থাকিয়া বৃথা ধরণীর ভার বৃদ্ধি করিও না। আমাদের দেশের নাম যদি হয় হিন্দুস্থান, তবে ইংরেজরা এখানে রাজত্ব করে কোন অধিকারে?” গণেশ চতুর্থী পালনের মধ্যে তাই স্বাধীনতার স্পৃহা। মতপ্রকাশ, রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড, আপন ধর্মীয় উপাসনায় যখন শাসকদল রক্তচক্ষু বিস্তার করে, তখন গণেশ পূজা তার বিপ্রতীপে এক অদম্য প্রতিরোধের নাম। গণেশ দেবতার ধ্যান ও ষোড়শোপচার পূজার মধ্যে এক অদম্য উচ্ছাস, এক তারুণ্যের ছোঁয়া, এক কালজয়ী ইতিহাস। গণপতি বাপ্পা সিদ্ধিদাতা, তিনি সকল কর্মের প্রারম্ভে স্মরণ-মননের যোগ্য শক্তি। তিনি অস্ত্র বিহীন নন। তাঁর চারহাত। এক হাতে শঙ্খ, এক হাতে চক্র, তৃতীয় হাতে গদা, চতুর্থ হাতে পদ্ম। তাই তিনি মহাবল এবং পূজা-সিদ্ধির অনুকূল দেবতা। তিনি মঙ্গলের দেবমূর্তি, তিনি সিদ্ধির জনক, তাই সকল দেবতার আগে তিনি পূজ্য, স্মরণযোগ্য।

আগামী ৩১ শে আগষ্ট, ২০২২ (১৪ ই ভাদ্র, ১৪২৯) শুভ গণেশ চতুর্থী। এদিন সিদ্ধিলাভের আকাঙ্খায় প্রার্থনা করার দিন। সাত সমুদ্র তেরো নদী পেরিয়ে একদা বাঙালি সফলভাবে বাণিজ্য-কর্ম করেছে। ময়ূরপঙ্খী নৌকা ভাসিয়েছে। অতীতের সেই গৌরবের, সেই সাফল্যের দিন কি আর ফিরে আসবে? গণপতি বাপ্পাই জানেন, বাঙালির সিদ্ধিলাভ কবে হবে! বাঙালি তার বাণিজ্য-লক্ষ্মীকে কবে হারিয়েছে, সে ইতিহাসটুকু যথার্থভাবে লিখে রাখতেও পারেনি। বলা যায়, চায়নি লিখে রাখতে। গণেশ এবং কার্তিকের সহাবস্থান চাই। যেমন চাই লক্ষ্মী-সরস্বতীর সহাবস্থান। তবে বাঙালি সফল হবে। কার্তিকের আরাধনা মানে, শক্তির পূজা, সাহসী হবার প্রার্থনা; সেনাপতির মতো সাহস, অজেয় পুরুষত্ব। বাঙালি নিজেরাই নিজেদের হারিয়ে দিয়েছে। ‘ময়ূরপঙ্খী নৌকো’ মানে কার্তিকের ক্ষাত্রশক্তিকে সঙ্গে নিয়ে বাণিজ্য। ময়ূর তাঁর বাহন। রূপক-সংকেতে ‘ময়ূরপঙ্খী নৌকা’ হয়ে দাঁড়ায় বীরত্বের সঙ্গে ব্যবসা, সুদূরের হাতছানি, এগিয়ে যাওয়ার মন্ত্র। ভর্তুকি-নির্ভর জাতি ব্যবসা করবে কি! ভর্তুকি ভেতরে ভেতরে ভয়ানক জেদকে জল করে দেয়। ভর্তুকি মানুষকে ভিখারি করে, ব্যবসায়ী করে তোলে না কখনও। সিদ্ধিলাভের তো প্রশ্নই নেই।

পেটে বিদ্যা না নিয়ে অবৈধ-সম্পদের মালিক হওয়াও যা, ‘ভীতুর-ডিম’ বাঙালির ব্যবসায়ী হওয়াও তাই। শুধু খেরোখাতা থাকলেই হয় না, খেরোখাতা রক্ষা করার বীরত্বটুকু থাকা চাই। পূর্ব পাকিস্তানে/বাংলাদেশে বাঙালি বণিক তার খেরোখাতার দখল রাখতে পারেনি। তাই গণেশ আর কার্তিকের যুগ্ম-আরাধনার স্বপ্ন দেখাতে হবে বাঙালিকে। পাশের ব্যবসায়ীর ‘গণেশ উল্টিয়ে’ বাঙালি কখনও বড় হতে পারবে না। রাজনৈতিক দংশনে ‘গণেশ হারানো’ মাছের ব্যবসায়ীটির কান্নায় যদি অন্য ব্যবসায়ীর হৃদয় কেঁদে না ওঠে, তবে কিসের গণেশ পুজো? বাঙালি-বণিককে সমবেতভাবে গণেশকে সোজা করে রাখতে হবে।

ভারতের অন্তরের ধাত্রী অরণ্য। ভারতের শিক্ষালাভ সম্পন্ন হতো তপোবনের সামীপ্যে সান্নিধ্যে। তারই ফুলে-ফলে-পল্লবে-শাখায় একদিন মানুষ বেড়ে উঠেছিল। অরণ্যে অতিবাহিত করে পশুত্বকে জলাঞ্জলি দিয়ে নরত্বে এবং সেই পথ ধরে দেবত্বে উপনীত হয়েছে ভারতের মানুষ। অরণ্যের হাতি-দেবতা হয়েছেন ‘সিদ্ধিদাতা গণেশ’। উত্তরবঙ্গের কৌমসমাজও হাতি-দেবতা ‘মহাকাল’-এর নিত্য স্মরণ করে। গণেশ কল্পনায় যেন অরণ্য-কৃষির যুগলবন্দী।

কৃষিজীবী মানুষ মাত্রেই জানেন হাতি অরণ্য সন্নিহিত কৃষিক্ষেত্রে কতটা বিঘ্নকারী পশু! পশ্চিমবঙ্গের জঙ্গলমহলে যখন দলমা পাহাড় থেকে দলে দলে হাতির পাল নেমে এসে ফসলের জমি তছনছ করে যায়, তখন তাকে কী বলা যাবে, দেবতা? হাতি নিজেই বিঘ্নকারী আর বিঘ্নের প্রতীক। গণেশের বাহনটিও তো তাই — ইঁদুর পাকা ফসল কাটে, যত না খায় তার চাইতে ঢের সংগ্রহ করে তার গর্তে। সুতরাং একদিকে হাতি, আর একদিকে ইঁদুর। হাতিমুখো গণেশ সওয়ার হয়েছেন কিনা অলক্ষ্মীরূপী ইঁদুরের পিঠে! কৃষিজীবনের পরতে পরতে এরা সর্বনাশের প্রতিভূ। অন্তত হাতিমুণ্ডধারী, ইঁদুর বাহন ফসল-বন্ধু হতে পারেন না। আর এখানে রয়েছে এক মনস্তাত্ত্বিক লোক-দর্শন; চিন্তার বৈপরীত্য। ভয়ে-ভক্তিতে এক বিঘ্নকারী শক্তি হয়ে ওঠে বিঘ্ননাশক দেবতা। বিঘ্নকারীকে নিয়ে জীবন অতিবাহিত না করে বিঘ্ননাশকের দরকার লোকসমাজের। মানুষ কল্পনা করলো — যিনি দুর্গতির হেতু, তিনিই আবার কল্যাণময়; তাই ইঁদুর বাহন হস্তিদেবতা যেন ছেড়ে দিয়েছেন তার চিরাচরিত বিঘ্নকারী স্বভাব। চিন্তার এই বৈপ্যরীত্যে ভয়ঙ্কর-শক্তি হয়ে যায় শুভঙ্কর-শক্তি। আর সেকারণেই ফসল ভক্ষণকারী হাতির পাল হয়ে দাঁড়ায় কৃষি সহায়ক দেবতা। নৃতত্ত্বের ভাষায় গণেশ হচ্ছেন থেরিওমর্ফিক দেবতা বা অর্ধ-মানুষ দেবতা; তার মুণ্ডটি প্রাণীর আর বাকি অংশটি মানুষেরই মতো। অরণ্যের প্রান্তবাসী লোকসমাজের কাছে গণেশ কেবল হস্তীদেবতাই নন, তিনি হাতিদেরও দেবতা। গণেশ তার হাতি রূপে বন্যপ্রাণী আর অরণ্য-সংস্কৃতির প্রতীক।

সভ্যতার বিবর্তনে দেখি আদিতে ছিল অরণ্য-কেন্দ্রিক মানব সভ্যতা — বনের ফল-মূল সংগ্রহ আর পশুশিকার করেই করেই মানুষের খাদ্য-সংস্কৃতি গড়ে উঠেছিল; কৃষি-সভ্যতা এসেছে অনেক অনেক পরে। বন ছেড়ে মানুষ যখন বন-সংলগ্ন জমি হাসিল করে মানুষ চাষাবাদ শুরু করলো, তার লোভে দলে দলে আবির্ভূত হল বনের শাকাহারি, তৃণভোজী পশুর পাল। তাদের থেকে ফসলকে বাঁচাতে আদিম মানুষ সর্তক হল আর তাদের প্রাচীন রীতিতে বনের পশুকে সন্তুষ্টকরণ করতে উদ্ভূত হল হস্তী দেবতা, তিনিই আজকের সিদ্ধিদাতা গণেশ।

গণেশের ধ্যান

ওঁ খর্ব্বস্থূলতনুং গজেন্দ্রবদনং লম্বোদরং সুন্দরং প্রস্যন্দন্মদ-গন্ধলুব্ধমধূপব্যালোলগণ্ডস্থলম্। দন্তাঘাতবিদারিতারিরুধিরৈঃ সিন্ধুর-শোভাকরং, বন্দে শৈলসুতাসুতং গণপতি সিদ্ধিপ্রদং কর্মসু।।

ষোড়শোপচারে পূজা কীভাবে?

এতৎপাদ্যং ওঁ গাং গণেশায় নমঃ। ইদমর্ঘ্যম, এতদাচমনীয়োদকম্, এতৎ স্নানীয়োদকম, এষ গন্ধঃ, এতৎ পুষ্পম্ (এতানি পুষ্পানি), এষ ধূপঃ, এষ দীপঃ, এতৎ সঘৃতোপকরণামান্ননৈবেদ্যম, এতৎ পানার্থোদকম্, এতদাচমনীয়োদকম্, এতৎ তাম্বুলং (অভাবে তাম্বুলার্থোদকম)।

প্রচ্ছদ ছবি: সৌম্যদীপ সরকার।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *