অর্জুনের লক্ষ্যভেদ 🎯 বন্যেরা বনে সুন্দর শিশুরা মাতৃক্রোড়ে

রজত ভরদ্বাজ মুখার্জী
আমাদের ভারত, ২২ মে: আমার এই লেখার হেডলাইন দেখে আঙুর ফল টক গোছের আত্মতুষ্টি নিয়ে যারা আনন্দে দু’হাত তুলে নৃত্য করছেন, তাদের উদ্দেশ্যে বিনম্রতাপূর্বক বলতে চাই, না বন্ধু আঙুর ফল সব ক্ষেত্রে মোটেই টক নয়। বরঞ্চ বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই আঙুর ফল অত্যন্ত সুস্বাদু ও সুমিষ্ট, এ উপলব্ধি আমার ব্যক্তিগত জীবনের অভিজ্ঞতা সঞ্জাত।

আজ থেকে ঠিক এক বছর আগে মুকুল রায়ের তৃণমূলে প্রত্যাবর্তনের ঠিক অব্যবহিত পরে পরেই আমি একটি প্রতিবেদন লিখেছিলাম যার শীর্ষক ছিল :

“একূল ওকূল হারিয়ে দুকূল,
মাঝ দরিয়ায় ভাসছে মুকুল”।

আমার সেদিনের ভবিষ্যত বাণী আজ বর্ণে বর্ণে সত্য প্রমাণিত হয়েছে। অর্জুন সিংহের ক্ষেত্রে অবশ্য বিষয়টা কিছুটা অন্যরকম হতে পারে, কারণ অর্জুনবাবু বাহুবলী এবং হিন্দীভাষী সমাজের প্রতিনধি। ব্যারাকপুর অঞ্চলটি হিন্দীভাষী অধ্যুষিত হওয়ার দরুণ অর্জুন সিংহের কিছুটা জনভিত্তি আছে। তাই অর্জুনের অস্তমিত হওয়াটা অবশ্যম্ভাবী হলেও কিছুটা সময় সাপেক্ষ। রাজনীতির একজন নিষ্ঠাবান শিক্ষানবিশ হিসেবে অতি সহজেই অনুধাবন করতে পারি যে, অর্জুন সিং, জয়প্রকাশ মজুমদার, মুকুল রায় বা বাবুল সুপ্রিয়র ন্যক্কারজনক রাজনৈতিক উচ্চাকাঙ্খা আজ সর্বজনবিদিত এবং বাংলার হাটে মাঠে ঘাটে তীব্র সমালোচিত। এনারা কেউই সে অর্থে জনদরদী রাজনেতা নন এ সত্য আজ সমাজের সর্বস্তরে প্রতিষ্ঠিত। শুধুমাত্র নিজেদের সঙ্কীর্ণ রাজনীতির লক্ষ্য পূরণ করার বাসনাতেই যে এনাদের বিজেপিতে পদার্পণ তা তো আজ প্রমাণিত সত্য। যেনতেন প্রকারেণ ক্ষমতার আলিন্দে থেকে রাজনৈতিক সিদ্ধিলাভ একমাত্র উপজীব্য।

বাংলার মানুষ অন্তঃসারশূন্য এই সকল রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বদের চিরতরে বর্জন করবেন, কারণ এখানকার আবালবৃদ্ধবনিতা প্রবল ভাবে রাজনীতি সচেতন। এক্ষেত্রে সিপিএমের অগস্ত্যযাত্রা বিশেষ ভাবে স্মরণীয়। প্রাক্তন রাজ্য সভাপতি মাননীয় দিলীপ ঘোষ প্রকাশ্যেই এই সমস্ত বেনোজল আগমণের ক্ষেত্রে সরব হয়েছিলেন, প্রতিরোধ গড়ে তোলার চেষ্টাও করেছিলেন কিন্ত অসফল হয়েছেন কারণ সেদিন সংখ্যাগরিষ্ঠ শীর্ষ নেতৃত্বের মতামত তাঁর বিপক্ষে গিয়েছিল। বেনোজল প্রতিরোধে ব্যর্থ হলেও আজ দিলীপদা স্থান করে নিয়েছেন বাঙালীর হৃদয়ে, মনের মণিকোঠায়।

নিশ্চয়ই স্মরণে আছে যে একদা তৃণমূলের দোর্দন্ডপ্রতাপ বেতাজ বাদশা অর্জুন সিংহের দলত্যাগের একমাত্র কারণ ছিল যে তিনি বারবার দরবার করা সত্ত্বেও তৃণমূল নেত্রী তাঁকে ব্যারাকপুর লোকসভা কেন্দ্রের মনোনয়ন দেননি। একান্তে বৈঠক করেও দলনেত্রী অর্জুনবাবুর দাবিকে পত্রপাঠ নস্যাৎ করে দিয়েছিলেন, যা নিয়ে বাহুবলী নেতা একাধিক বার প্রেসের সামনে নিজের ক্ষোভ উগড়ে দেন। আজ আবার গৃহত্যাগী অভিমানী অর্জুন স্বগৃহে প্রত্যাবর্তন করলেন। তাঁকে সাদরে আপ্যায়িত করলেন পশ্চিমবঙ্গের যুবরাজ অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় স্বয়ং। আসলে মানুষের জীবন থেকে নীতি নৈতিকতার স্খলন হলে তার পতনও অনিবার্য হয়ে দাঁড়ায়, অর্জুন সিংহের ক্ষেত্রেও এর ব্যতিক্রম হবেন না বলেই, আমার বিশ্বাস।

প্রণিধানযোগ্য যে পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য বিজেপি সাফল্যের শিখরে আরোহণ করেছিল পূর্বতন রাজ্য সভাপতি দিলীপ দার কার্যকালেই। অনস্বীকার্য যে আজ দলকে শক্ত ভিতের ওপরে দাঁড় করানোর শ্রেষ্ঠ কুশীলব দিলীপদাই, তিনিই দলের ভেতর প্রাণশক্তি যোগানের ভগীরথ। স্পষ্টবক্তা, দৃঢ়চেতা অমিতবিক্রম দিলীপদা কে যোগ্য সঙ্গত করেছিলেন তৎকালীন সাধারণ সম্পাদক সংগঠন সুব্রত চট্টোপাধ্যায় মহাশয়। সত্যি কথা বলতে সেখান থেকেই বিজেপির স্বর্ণযুগের শুরু। 18 টি সাংসদ, 77 টি বিধায়ক, বিধানসভা নির্বাচনে 40% ভোট যা সংখ্যার নিরিখে 2 কোটি 28 লক্ষ, এই সকল পরিসংখ্যানই দিলীপদার সাফল্যের স্বপক্ষে এক প্রামাণ্য দলিল।

সময় এগিয়েছে, কালের আপন নিয়মেই রাজ্য বিজেপির নেতৃত্বে পরিবর্তন এসেছে। দলের রাশ এখন নবনিযুক্ত সভাপতি সুকান্ত মজুমদারবাবুর হাতে। পাশে রয়েছেন সাধারণ সম্পাদক সংগঠন অমিতাভদা। ঠিক যেখানে শেষ করেছিলেন দিলীপদা–সুব্রতদা জুটি, ঠিক সেই জায়গা থেকেই শুরু করেছেন উত্তরসূরীরা। কি অদ্ভুত সমাপতন, যেন এক অভূতপূর্ব যুগসন্ধিক্ষণের সাক্ষী রয়ে গেলাম আমরা।

রাজনীতি যদি আক্ষরিক অর্থেই সম্ভাবনার শিল্প হয়ে থাকে, তাহলে এই মুহূর্তে তার সেরা বাজি নিঃসংশয়ে সুকান্ত মজুমদার ও অমিতাভ চক্রবর্তী যুগলবন্দী। রাজ্য সভাপতি অধ্যাপক গবেষক সুকান্তবাবু যদি হন শিক্ষা প্রজ্ঞা মেধা মননের এক সামগ্রিক বিজ্ঞাপন, তাহলে নিশ্চিত ভাবেই বলা যায় যে অমিতাভ দা একজন প্রাজ্ঞ ও দক্ষ সংগঠক যার চারিত্রিক দৃঢ়তা ও সাংগঠনিক দক্ষতা বিবিধ ক্ষেত্রে বারেবারে প্রমাণিত হয়েছে। সুকান্তবাবু ও অমিতাভ দার যুগলবন্দী গোড়াতেই দলের সাংগঠনিক খোল নলচে পাল্টে দিয়ে, নবীন প্রবীণের যথার্থ সমন্বয় সাধন ঘটিয়ে স্পষ্ট বার্তা দিয়েছেন যে তাঁরা কেবলমাত্র রাজনীতি রাজনীতি খেলতে মাঠে নামেননি, তাঁরা বস্তুতপক্ষেই তমসাচ্ছন্ন পশ্চিমবঙ্গের রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের পথিকৃত হতে জন্মগ্রহণ করেছেন।

অতএব কে এলেন কে গেলেন বিচার্য নয়, রাজনীতিতে শেষ কথা বলেন গণদেবতা অর্থাৎ সাধারণ মানুষ। মানুষের হৃদয়ে চিরস্থায়ী জায়গা করে নিয়েছেন মাননীয় প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর নেতৃত্বাধীন ভারতীয় জনতা পার্টি। অতএব অর্জুন চলে গেলেও দ্রোনাচার্য্য আমাদের সঙ্গেই আছেন, প্রয়োজনে আরও কিছু অর্জুন, নকুল, সহদেব তৈরি করে নেওয়া যাবে। ছোটখাট ঘটনা বিব্রত করে না বাঙালী সমাজকে, সুতরাং অর্জুন সিংহের প্রত্যাবর্তন কোনওভাবেই দাগ কাটে না আপামর বাঙালীর মানসপটে।

পরিবর্তনকামী বাঙালীর এখন আকর্ষণের একমাত্র কেন্দ্রবিন্দু সুকান্ত–অমিতাভ জুটির T 20 মেজাজের মারকাটারি ঝোরো ইনিংস যা রাজ্য রাজনীতিতে রচনা করবে ইতিহাসের এক নতুন অধ্যায়। হয়তো আজকের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে দাঁড়িয়ে আমার বক্তব্য অনেকের কাছেই অহেতুক ও অতিরিক্ত আত্মবিশ্বাস বলে প্রতিপন্ন হতে পারে, তাদের কাছে আমার সবিনয় নিবেদন, “জন্ম যদি তব বঙ্গে তিষ্ঠ ক্ষণকাল।”
(লেখক পশ্চিমবঙ্গ বিজেপির আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের প্রমুখ।)

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *