রাষ্ট্রবিজ্ঞানে এমএ ও ক্যারাটেতে ব্লাকবেল্ট রাজকুমার এখন ফেরিওয়ালা

স্বরূপ দত্ত, উত্তর দিনাজপুর, ৮ এপ্রিল: ফেরি করেই জীবন সংগ্রাম করে চলেছে উচ্চশিক্ষিত রাজকুমার। রায়গঞ্জ ব্লকের মণিপুর অঞ্চলের কান্তরের বাসিন্দা রাজকুমার মাহাতো(২৫) পেশায় ফেরিওয়ালা। তবে পড়াশোনার জন্য রায়গঞ্জ শহরের উকিলপাড়াতেই তার বর্তমান অস্থায়ী বাসস্থান।

রাষ্ট্রবিজ্ঞানে এম এ ও ক্যারাটেতে ব্লাকবেল্ট রাজকুমার। ছোট্ট ফেরিগাড়িতে মনিহারি সামগ্রী সাজিয়ে গ্রামে গ্রামে ফেরি করে বেড়ায়। সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত ফেরিগাড়ি নিয়ে গ্রামগঞ্জে ঘুরে বেড়ায় সে।পরিবারের সদস্যদের সুখে শান্তিতে রাখার পাশাপাশি নিজের পায়ে দাঁড়াতে কঠোর পরিশ্রম করে রাজকুমার। সপ্তাহে ৩ দিন রায়গঞ্জ শহর ও শহরতলি এলাকায় ক্যারাটে প্রশিক্ষণ দিতেও দেখা যায় তাঁকে।

ফেরিওয়ালা রাজকুমারের পেশার সঙ্গে  তার শিক্ষাগত যোগ্যতা মোটেই মানানসই নয়। তবু জীবনে প্রতিষ্ঠিত হতে ফেরিওয়ালা পেশাকে বেছে নিয়েছে সে। বাবা পেশায় কৃষক। অনটনের সংসারে একটি সরকারি চাকরির খুব প্রয়োজন থাকলেও নিজের পেশাকে পরিহাস বলতে মানতে নারাজ সে।

রাজকুমার ২০১৫ সালে ভগিলতা হাই স্কুল থেকে মাধ্যমিক পাস ও ২০১৭ সালে উচ্চমাধ্যমিক পাস করার পর রায়গঞ্জ সুরেন্দ্রনাথ কলেজে রাষ্ট্রবিজ্ঞান অনার্স নিয়ে ভর্তি হয়। এরপর রায়গঞ্জ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এমএ পাশ করে সে। এমএ পড়ার সময় রায়গঞ্জে চলে আসে সে।মেলায় মেলায় বেলুন বিক্রি করে নিজের  পড়াশোনার খরচ জোগাড় করত রাজকুমার। কিছু টাকা পয়সা জোগাড় হতেই ভ্যানগাড়ি তৈরি করে মনিহারি সামগ্রী বিক্রি করতে শুরু করে। পাশাপাশি চালিয়ে যায় ক্যারাটে প্রশিক্ষণ। ক্যারাটেতে ব্ল্যাক বেল্ট পাওয়ার পর গ্রামের ছাত্র-ছাত্রীদের প্রশিক্ষণ দেওয়ার জন্য মহারাজা মোড়ে একটি স্কুলও চালু করেছে।

এত পরিশ্রমের পরেও হাসিখুশি রাজকুমারের ইচ্ছে অলিম্পিকে অংশ নেওয়া। তার বিশ্বাস, অংশ নিলে সে সোনা আনবেই। গত ২০ মার্চ রাজকুমার রায়গঞ্জ থেকে কলকাতার উদ্দ্যেশ্যে পায়ে হেঁটে রওনা দিয়েছিল এবং ৬ দিনে সে কলকাতায় পৌঁছায়। ইচ্ছে ছিল মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করে গ্রামেগঞ্জে ছেলেমেয়েদের  মোবাইল ফোনের অত্যাধিক ব্যবহার বন্ধের জন্য গ্রাম্য খেলাধুলার পরিবেশ ফিরিয়ে আনার দাবি জানাবেন, কিন্তু দেখা করার সুযোগ পায়নি সে।

রাজকুমার জানায়,ফেরি করে যে আয় হয় তা দিয়ে  চাকরির জন্য পড়াশোনার খরচ এবং সংসারের খরচটুকু ওঠে। কঠিন লড়াই করতে হয়। নেট ও স্লেটের জন্য চেষ্টা করছে। বাবা রামদেব মাহাতো গ্রামেই থাকেন। অন্যের জমিতে কাজ করেন। মা মিনাদেবী মাহাতো অসুস্থ। মা, বাবা ও চার ভাইবোন নিয়ে কোনো রকমে চলে তাদের সংসার। উকিলপাড়ার এক বাসিন্দা রাজকুমারকে থাকতে দিয়েছেন, এজন্য কোনো ভাড়া নেন না।

রাজকুমার জানায়, ইচ্ছে শিক্ষক হওয়ার। কিন্তু আমাদের মতো গরিব মানুষদের কাছে চাকরি স্বপ্নের মতো। কারন এখন যোগ্যতার দাম নেই, টাকা দিলেই চাকরি মেলে।

এদিন রাজকুমারের ঘরে গিয়ে দেখা গেল ঘরের দেওয়ালে ঝোলানো রয়েছে অনেক মেডেল। জাতীয়, রাজ্য ও জেলা স্তরে ক্যারাটেতে অংশ নিয়ে কোনোবার প্রথম, আবার কোনোবার দ্বিতীয় হয়েছে সে। তার আক্ষেপ এত মেডেল রয়েছে, কিন্তু কোনো সম্মান নেই। প্রতিবেশীদের কাছে অত্যন্ত নম্র ভদ্র এবং গুণী ছেলে রাজকুমার। প্রতিবেশি লক্ষ্মী চৌহান বলেন, উচ্চশিক্ষিত হয়েও সে যেভাবে ফেরি করে নিজের পড়াশোনার পাশাপাশি সংসার চালায় সত্যি ভাবা যায় না। এমন ছেলে দেখা যায় না। ওর একটা চাকরি দরকার। পাড়ার ছেলেমেয়েরা খুব ভালোবাসে ওকে। সোনিয়া চৌহান নামে পাড়ার এক ছাত্রী জানায়, দাদা খুব ভালো মানুষ। আমাদের সঙ্গে খেলাধুলা করে। আমাদের খুব সাহায্য করে। দাদার একটা চাকরি দরকার। প্রাথমিক, মাধ্যমিক, গ্রুপ সি, গ্রুপ ডি  সকল ক্ষেত্রেই রাজ্য সরকার দুর্নীতির অভিযোগে অভিযুক্ত। ঠিক এইরকমই এক সময়ে রাজকুমারের লড়াই কি কর্মসংস্থান প্রশ্নে রাজ্য সরকারের ভূমিকার দিকে আঙ্গুল তুলছে না? এই প্রশ্নই ঘুরছে মানুষের মনে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *