সোমনাথ বরাট, আমাদের ভারত, বাঁকুড়া, ১৭ জুলাই: সমবায় সমিতির নির্বাচন নিয়ে ক্ষোভ বিক্ষোভে ক্রমেই উত্তপ্ত হয়ে উঠছে জেলা। মনোনয়ন পত্র জমা দিতে না পারায় পঞ্চায়েত নির্বাচনের ছায়া দেখছে বিরোধী শিবির। দেখা যাচ্ছে প্রতিটি সমবায় সমিতিতে শাসক দলের প্রার্থীরা বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জয়ী হয়েছেন বা হচ্ছেন।জেলার বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলি মনোনয়ন পত্র জমা দিতে পারছে না। এমনকি কোনো নির্দল প্রার্থীও থাকছে না এই নির্বাচনগুলিতে।
শাসক দলের বক্তব্য, তৃণমূলের উন্নয়নের কাজ দেখে কোনো প্রার্থী বা প্রস্তাবক খুঁজে পাচ্ছে না বিরোধীরা। অন্যদিকে বিজেপি, সিপিএম ও কংগ্রেস সহ সব রাজনৈতিক দল ২০১৫ সালের পঞ্চায়েত নির্বাচনের ছবি দেখতে পাচ্ছেন এই সমবায় নির্বাচনে। বিরোধীরা মনোনয়নপত্রই জমা দিতে পারেননি সেবার। রাজ্যজুড়ে প্রতিবাদের ঝড় ওঠে। সরব হয়ে ওঠে সংবাদমাধ্যমগুলি। মনোনয়ন জমা দেওয়ার শেষ সময় একদিন বাড়ানো হয়।সকলে প্রস্তুতি নেয় সর্বশক্তি নিয়োগ করে মনোনয়নপত্র জমা দেবেন। কিন্তু সেদিন সকালেই রাজ্য নির্বাচন কমিশন আরেকটি বিজ্ঞপ্তি জারি করে মনোনয়নপত্র জমা দেওয়ার যে এক দিন সময় বাড়িয়ে দেওয়ার বিজ্ঞপ্তি জারি করেছিল, তা বাতিল করে দেয়। রাজ্যের সব বিরোধী দল সন্ত্রাস, পুলিশ, প্রশাসন ও নির্বাচন কমিশনের চাটুকারিতার অভিযোগ তুলে সরব হয়ে ওঠে। সেই ছবি জেলার সমবায় নির্বাচনে দেখতে পাওয়া যাচ্ছে।
গত ১৫ জুলাই ২৫ মঙ্গলবার জয়পুর ফারমার্স সার্ভিস কো অপারেটিভ সোসাইটির পরিচালন সমিতির নির্বাচনের জন্য মনোনয়নের শেষ দিন ছিল। এই শেষ দিন পর্যন্ত বিরোধী বা নির্দল মনোনয়ন জমা না দেওয়ায় ওই সমবায়ের ২৯টি আসনেই বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জয়ী হয় তৃণমূল প্রার্থীরা।
বিজেপির বিষ্ণুপুর সাংগঠনিক জেলার মুখপাত্র দেবপ্রিয় বিশ্বাস বলেন, সন্ত্রাস করে বিরোধীদের মনোনয়ন করতে দেয়নি শাসক দল তৃণমূল। ছাব্বিশের বিধানসভা নির্বাচনে মানুষ এর ফল দেখাবে।
অন্যদিকে তৃণমূলের জয়পুর ব্লকের সভাপতি কৌশিক বটব্যাল বলেন, তাদের দল ২৯টি সিটে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জয়লাভ করেছে। আসলে প্রতিটি আসনের জন্য একজন করে প্রার্থী ও একজন করে প্রস্তাবক খুঁজে না পেয়েই বিরোধীরা প্রার্থী দিতে পারেনি। জয়পুর ফারমার্স সার্ভিস কো অপারেটিভ সোসাইটির পরিচালন সমিতিতে একসময় একচেটিয়া দাপট ছিল বামেদের। ২০১১ সালে এই সমবায়ের পরিচালন সমিতির দখল নেয় তৃণমূল। তারপর থেকে লাগাতারভাবে এই সমবায়ের রাশ রয়েছে তৃণমূলের হাতে। বামেদের মতে বিরোধীরা প্রার্থী ও প্রস্তাবক পাচ্ছে না অত্যাচার ও নিরাপত্তার ভয়ে। শিক্ষা ও স্বাস্থ্যের পর সমবায়কে কুক্ষিগত ও দুর্নীতির আঁখড়া করতে চাইছে শাসক দল। অন্যদিকে এই জয়লাভের পর বিজয়োল্লাসে মেতে ওঠে ঘাসফুল শিবির। সম্প্রতি বাঁকুড়ার বড়জোড়া ব্লকের পখন্না সমবায় সমিতির পরিচালন সমিতির সদস্য নির্বাচন হয়। এই সমবায়ের ৯টি আসনেই তৃণমূল প্রার্থীরা বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জয়লাভ করে। এই জয়ের পর আবির খেলাও হয়। তবে এটা নির্বাচনের নামে প্রহসন হয়েছে বলে সরব হয়েছেন সব বিরোধীরা।
সিপিএম নেতা মনোরঞ্জন দে ও বিজেপির বড়জোড়া ৩ নম্বর মণ্ডলের সভাপতি ধনঞ্জয় গরাইদের বক্তব্য, নির্বাচন ও মনোনয়নের দিন ঘোষণার পর তা নোটিস দিয়ে সকলকে জানানো নিয়ম। কিন্তু সে নিয়মকে তোয়াক্কা না করে সকলকে অন্ধকারে রেখেই শাসক দল নেতাদের ঘরে বসে মনোনয়ন জমা দেয়। পরবর্তীতে তাদেরই জয়ী বলে ঘোষণা করা হয়। নেতারা ঘরে বসে সমবায়ের মনোনয়ন পর্ব সেরে ফেলায় বিরোধীরা মনোনয়নের কোনও সুযোগই পায়নি। তাদের দাবি, পখন্না সমবায়ে ভোট হলে ফলাফল অন্য রকম হতো। যদিও বিরোধীদের অভিযোগ মানতে নারাজ তৃণমূল। বাঁকুড়ার জয়পুরের উত্তরবাড় ও তালডাংরা সমবায় সমিতিতেও দেখা গিয়েছে একই ছবি। গত জুলাই-২৫ বাঁকুড়ার জয়পুর ব্লকের উত্তরবাড় অঞ্চল সমবায় সমিতির সদস্য নির্বাচনের মনোনয়ন জমার শেষ দিনেও বিরোধীদের কোনো মনোনয়ন জমা পড়েনি। এতে সমিতির ৫৯টি আসনেই বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জয়ী হয় তৃণমূল। শাসক দল তৃণমূল এবার বাকিদের মনোনয়ন জমা করতেই দেয়নি বলে অভিযোগ বিরোধীদের। যদিও সেই সব অভিযোগ উড়িয়ে দিয়েছে শাসক শিবির। এখানেও জয়ের পর তৃণমূলের জেলা ও ব্লক নেতৃত্বের সঙ্গে সবুজ আবির খেলেন জয়ী প্রার্থীরা।
তৃণমূলের জেলা সভাপতি সুব্রত দত্ত বলেন, বিরোধী শূন্য করে সমবায়ের পরিচালন সমিতির নির্বাচনে এই জয় আসলে উন্নয়নেরই জয়। এই জয়কে পাথেয় করেই ২০২৬ সালের বিধানসভা ভোটে বিষ্ণুপুর মহকুমার ৬টি আসনেই জয়ের পতাকা ওড়াবে তৃণমূল। তালডাংরার সমবায় কৃষি উন্নয়ন সমিতির নির্বাচনে ৯টি আসনে বিরোধীদের কোনো প্রার্থী মনোনয়ন জমা না দেওয়ায় সব কটি আসনেই বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জয়লাভ করে তৃণমূল। জয়ের পর একই ভাবে তৃণমূলের জেলা নেতৃত্ব থেকে শুরু করে ব্লক নেতৃত্ব ও জয়ী প্রার্থীরা সবুজ আবির খেলায় মেতে ওঠে। গত ২০১৯ সালের পর থেকে এই সমবায় সমিতিতে কোনো নির্বাচন হয়নি। এবার ২০২৫ এ বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় সবকটি আসনে জয়ী শাসক দল।
অন্যদিকে বিজেপি’র রাজ্য কমিটির সদস্য সৌগত পাত্র বলেন, “জয়লাভ আবার কী জিনিস। মনোনয়ন পেশ করতে দিলে তবে তো নির্বাচন হবে? শাসক দল পুলিশের সাথে হাত মিলিয়ে কোনো বিরোধী প্রার্থীকে মনোনয়ন পেশ করতে দেয়নি। গায়ের জোরে নির্বাচন করিয়ে জয়লাভ করেছে তৃণমূল।
তৃণমূলের বাঁকুড়া সাংগঠনিক জেলা সভাপতি তারাশঙ্কর রায় বলেন, নাচতে না জানলে উঠোন বাঁকা।