আশিস মণ্ডল, আমাদের ভারত, বীরভূম, ৭ ডিসেম্বর: আদিবাসী গ্রামে ফের নৃশংসতার ছবি। নেপথ্যে ফের উঠে এসেছে কুসংস্কার, তন্ত্রসাধনা, অন্ধবিশ্বাসের জাঁকিয়ে বসার তত্বই। এক যুবকের জিভ কেটে নেওয়ার অভিযোগ উঠেছে এক প্রৌঢ়ার বিরুদ্ধে। আদিবাসী যুবকের বুকের উপর চেপে নির্মমভাবে তার জিভ কেটে নিয়েছে গাঁয়ের বছর পঞ্চাশের মহিলা পাকু টুডু এমনই জানিয়েছেন গ্রামের প্রতিটা মানুষ। শান্তিনিকেতন থানার ফুলডাঙা গ্রামের এই ঘটনায় ফের চাঞ্চল্য ছড়িয়েছে ব্যাপকভাবে।
ঘটনার সূত্রপাত সোমবার সন্ধ্যায়। ফুলডাঙার যুবক সোমাই সরেন ও অভিযুক্ত মহিলার সম্পর্কে নাতি মুকুল মুর্মুকে নিজের বাড়িতে হাড়িয়া খাওয়ার আমন্ত্রন জানায় পাকু টুডু। ঘটনার পর মদ্যপানের আসরে উপস্থিত মুকুল মুর্মু জানিয়েছেন, “ওরাই মদ খেতে ডেকেছিল। মদ খেতে খেতে আমি বাথরুম করতে বাইরে যাই। ফিরে এসে দেখি সোমাইয়ের বুকের উপর চেপে পাকু টুডু জিভ কাটছে। কোনও মতে সোমাইকে ছাড়িয়ে নিয়ে পালিয়ে আসি”।
গ্রামবাসীদের একাংশের দাবি, পাকু টুডু ও তার মেয়ে রানি টুডু এই ঘটনার সাথে জড়িত। পাকু তন্ত্রসাধনা করে। বাড়িতে তুকতাক করে। মন্দিরও বানিয়েছে ঘরে। তন্ত্রসাধনার জন্যই ‘বলি’ দেওয়ার উদ্দেশ্যে এই কান্ড ঘটিয়েছে পাকু। গ্রামের বাসিন্দা কমল সোরেনের দাবি মহিলা তান্ত্রিক তন্ত্রসাধনার জন্য কোনও এক উদ্দেশ্যে এই কান্ড ঘটিয়েছে। এদিকে আক্রান্তের অভিযোগের ভিত্তিতে পুলিশ পাকু টুডু ও তার মেয়ে রানি টুডুকে গ্রেপ্তার করেছে।
অপরদিকে গুরতর জখম অবস্থায় সোমাই সরেন হাপিত্যেশ করছেন চিকিৎসার খরচ জোগানোর জন্য। কারণ জখম অবস্থায় তাকে প্রথমে বোলপুর হাসপাতালে নিয়ে গেলে সেখান থেকে পাঠানো হয় বর্ধমান। বর্ধমানেও হয় চিকিৎসা, সেখান থেকে স্থানান্তর করা হয় কলকাতা। কিন্তু আর্থিক সঙ্গতি না থাকার ফের তাকে ফিরে আসতে হয়েছে গ্রামে। গ্রামের মানুষ এখন অর্থ সংগ্রহ করছে সোমাইয়ের চিকিৎসার জন্য।
তবে পুলিশের একটি সূত্র দাবি করেছে, স্রেফ তন্ত্রসাধনার উদ্দেশ্যেই যে এই জিভ কাটার ঘটনা তা নাও হতে পারে। এর পেছনে যুবকের সাথে মহিলার সম্পর্কের অবনতির কারণও থাকতে পারে। কারণ ঘটনার সময় মদ্যপানের আসরে বচসা হওয়ার প্রমাণ মিলেছে। আবার পাকু টুডুর মেয়ে রানি টুডুর ঘটনাস্থলে উপস্থিতির কোনও প্রমানই মেলেনি।
পুলিশের এক আধিকারিক জানিয়েছেন, “যেহেতু অভিযোগ করা হয়েছে মা ও মেয়ে দু’জনের নামে তাই দু’জনকে গ্রেপ্তার করতে হয়েছে। আরও খতিয়ে দেখা হচ্ছে ঘটনার নেপথ্যে আসল কি তত্ব রয়েছে”।
তবে বীরভূমে আদিবাসী মহল্লায় এমন নৃশংসতার নমুনা এই প্রথম নয়। বছরখানেক আগেই বোলপুরের কাছে রাধাকৃষ্ণপুর গ্রামেও ঘটেছিল আরও নির্মম ঘটনা। ‘ডাইনি’র আরাধনা চলছে। তার জন্য মাথায় ‘ভর’ পড়েছে গ্রামেরই এক মেয়ের। সেই ডাইনি দাপিয়ে বেড়াচ্ছে গ্রামজুড়ে। বিঘ্নিত হচ্ছে গ্রামের শান্তি। এমন অপবাদ দিয়ে কাঠগড়ায় তোলা হয়েছে ষাটোর্ধ্ব আদিবাসী বৃদ্ধ ফন্দি সর্দারকে। ফন্দি সর্দারই ডাইনের পূজারি এই খেসারতে সালিশী সভার নিদানে নিজের ছেলেকে দিয়ে কাটানো হয়েছিল বৃদ্ধের দু-হাতের দশটি আঙুলই। নিজের ছেলে দা দিয়ে কেটেছে বাবার দশ-দশটি আঙুল। এই ঘটনা স্তম্ভিত করেছিল সকলকে। শুধু তাই নয়, ঘটনায় গাঁয়ের শাসকদলের মাতব্বরদের বাধা দেওয়া তো দূর বরং তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ ছিল ঘটনায় প্ররোচনা দেওয়ার। তবে পরপর ঘটনায় এটা স্পষ্ট, কুসংস্কার, অন্ধবিশ্বাস, বুজরুকির কারবার যেভাবে মাথাচাড়া দিচ্ছে। সামাজিক নজরদারির কঙ্কালসার চেহারা স্পষ্ট হচ্ছে। ঠিক তেমনই আইন শৃঙ্খলার প্রতি সমীহ রাখার প্রবনতা কমছে।