প্রাক্তন সেনার চোখে অগ্নিপথে অগ্নিবীর

আমাদের ভারত, ২০ জুন: অগ্নিবীর প্রকল্পের বিশদ আলোকপাত করলেন অখিল ভারতীয় পূর্ব সৈনিক সেবা পরিষদের (পশ্চিমবঙ্গ) প্রাক্তন সাধারণ সম্পাদক, প্রাক্তন সুবেদার অসীম দে।

যে কোনও প্রকল্প ভালো না খারাপ, সেটা শুরু হওয়ার পরই বোঝা যায়। কিছু দরকার মতো পরিবর্তন বা পরিবর্ধন হয়। কিছু অপ্রয়জনীয় বন্ধ হয়ে যায়। শুরুতেই সব কিছুতে গেল গেল রব তুললে হবে না।

আজ অগ্নিপথ প্রকল্প নিয়ে আমাদের দেশের সকলেই অল্প বেশি মতামত দেওয়ার ক্ষমতা রাখতে পারেন। এই প্রকল্প আগামী দিনে সফল হবে কী না সেটা এখন থেকেই কেউ বলতে পারবেন না। আজ ভারতীয় সেনা যে জায়গায় পৌঁছেছে সেটা এক দিনে বা একটা কোনও প্রকল্পের দ্বারা হয়নি। নিরলস অবিছিন্ন ভাবে বছরের পর বছর নানা রকম প্রকল্পের পরীক্ষা নিরীক্ষার ফল। ভারতীয় সেনায় সব সময়েই নানা রকম যুগোপযোগী পরিবর্তন প্রক্রিয়া চলতেই থাকে। এই অগ্নিবীর প্রকল্প তার মধ্যে অন্যতম।

সবার প্রথমে আমাদের দেখতে হবে এই প্রকল্পের উদ্দেশ্য কি?
(ক) প্রধান উদ্দেশ্য হল- সেনাকে যুবক বানানো এবং সেনার গড় বয়স কমানো।
(খ) আগামী দিনে আমাদের দেশে যুবকদের একটি ভালো সংখ্যা সেনা প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত থাকে, তার ব্যবস্থা করা।
(গ) দেশের অসময়ে সৈন্য প্রশিক্ষিত অনুশাসন যুক্ত দেশপ্রেমে অনুপ্রানিত যথেষ্ট সংখ্যার যুবশক্তিদের দেশের কাজে লাগানো।
(ঘ) যথেষ্ঠ পরিমাণে প্রশিক্ষিত মানবশক্তি তৈরী করা ইত্যাদি।

যেহেতু সেনাবাহিনীর কথা বলা হচ্ছে সেহেতু এই বাহিনীর আবশ্যিকতার কথাই আলোচনা করতে হবে। বাকি অন্য সব চাকুরির মতো সেনার চাকুরি নয়। সেনার চাকরি কেবল যে টাকা পয়সার জন্য তা নয়। আমাদের দেশে প্রচুর গ্রাম আছে যেখানে সৈনিকদের জীবন অনেক বেশি গর্বের। অনেকেই প্রথমে নিজ নিজ সংসার প্রতিপালন করতেই আসে। তবে এই সৈন্য পরিবারে যোগদান করার পর এই পরিবারের কৃষ্টি সংস্কৃতি পরম্পরায় শিক্ষিত হয়ে সময়ের তালে তালে এই দেশকে রক্ষা করতে গিয়ে নিজের সর্বোচ্চ বলিদানের জন্য সব সময় তৈরী থাকে। যেটা অন্য সব চাকরির ক্ষেত্রে হয় না। পিছনে নিজের ছোট্ট পরিবারে মা বাবা ভাই বোন স্ত্রী সন্তানের থেকে আগে দেশমাতৃকাকে রক্ষার দায়িত্ব পালন করতে হয়। তখন নিজ পারিবার গৌন হয়ে যায় আর দেশমাতৃকাই মুখ্য হয়ে যায়।

অগ্নিপথ প্রকল্পে আরও কয়েকটি ভালো দিক আছে।
(১) আমাদের দেশের যুবশক্তি বেশি করে সেনাবাহিনীর সঙ্গে প্রতক্ষভাবে যুক্ত হবে। এখানে নানা ভাষা নানা জাত নানা সম্প্রদায় নানা পরিধান এক জায়গায় বিশাল সঙ্গমের মত মিলিত হয়ে সেনার প্রশিক্ষনের দ্বারা জাত পাত, ভাষা ভাষী, সম্প্রদায়, প্রাদেশিকতা এই সব নিম্ন মানসিকতার উপরে উঠে এক ভারত, শ্রেষ্ট ভারতের দৃষ্টিতে বলবান হবে। কী ভাবে সহাবস্থান করতে হবে শিখবে।
(২) মনে করুন ভারতীয় সেনাবাহিনীতে প্রতি বছর ১০,০০০ পদ খালি হচ্ছে। এই ১০,০০০ খালি পদ অগ্নিবীরের মাধ্যমে পুরণ হবে। তার জন্য সেখানে অগ্নিবীর হিসাবে ৪০,০০০ নিয়োগ করা হবে। চার বছর চাকরী করার পর ৩০,০০০ অগ্নিবীর প্রতি বছর সেনা থেকে বাইরে আসবে।
(৩) এই ৩০,০০০ ‘অগ্নিবীর’ পূর্ণ সৈন্য প্রশিক্ষন নিয়ে আসবেন। এখানে খেয়াল রাখতে হবে সেনাতে প্রশিক্ষণ কেবল হাতিয়ার চালানোই শেখানো হয়না। হাতিয়ার চালানো প্রশিক্ষণের মাত্র ১০%। বাকি ৯০% শারিরীক ও মানসিক শক্তি বৃদ্ধির প্রশিক্ষণ হয়। এই ৩০০০০ সৈন্য প্রশিক্ষন প্রাপ্ত যুব মানবশক্তি দেশে উপলব্ধ হবে যারা তখন আর্থিক ভাবেও সচ্ছল হবে। এই যুবশক্তি দেশকে এগিয়ে নিয়ে যাবে।

(৪)এবার বেতন মানের দিকে আসা যাক—
প্রথম বছর হাতে পাবে ২১০০০*১২ =২,৫২,০০০
দ্বিতীয় বছর হাতে পাবে ২৩১০০*১২ =২,৭৭,২০০
তৃতীয় বছর হাতে পাবে ২৫৫৮০*১২ = ৩,০৬,৯৬০
চতুর্থ বছর হাতে পাবে ২৮০০০*১২ = ৩,৩৬,০০০
অর্থাৎ, চার বছরে মোট ১১,৭২,১৬০/-। এককালীন চার বছর পর পাবে ১১,৭১,০০০/-। মোট আয় হবে ২৩, ৪৩, ১৬০ (আয়কর ছাড় দিয়ে)।
যদি কেউ সাড়ে সতের বছরে ‘অগ্নিবীর’ হয়ে সাড়ে একুশ বছর বয়সে বেরিয়ে আসে তার পরে স্নাতক বা আরও উচ্চ শিক্ষার জন্য পড়াশুনা করতে চায় তার নিজের কাছেই প্রায় কুড়ি লাখ টাকা থাকবে। স্বনির্ভর হবে। কারুর কাছে হাত পাততে হবে না।
এবার বলুন কোন চাকরীতে বাইশ বছর বয়সেই এই টাকাটা পাবে। এই সময়ের মধ্যে যদি কারুর মৃত্যু হয় তাহলে তার পরিবার মোটামুটি এক কোটি টাকার মতো পাবে। যদি অঙ্গহানি হয় তাহলে শতাংশ অনুসারে সর্বোচ্চ ৪৪ লাখ টাকা পাবে।

(৫) বর্তমানে সারা দেশের জনসংখ্যার ১% পরিবার সরকারি চাকুরি করে বাকি ৯৯% পরিবার নিজেই রোজগার করেন। এখানে প্রশ্ন, নীতি কাদের জন্য— ১% এর জন্য না ৯৯% এর জন্য?

আজ থেকে প্রায় ২০ বছর পর প্রায় ২২ লাখ সৈন্য প্রশিক্ষিত যুবশক্তি ভারতের কাছে থাকবে। যাদের গড় বয়স ৩৫ বছরেরও কম হবে। এই যুবশক্তি দেশের যেকোনও রকমের বিপদ আপদের মোকাবিলা করার ক্ষমতা রাখবে। বর্তমানে ভারতীয় সেনার গড় বয়স ৩২ বছর। এই অগ্নিপথ যোজনা চালু হলে সেনার গড় বয়স দাঁড়াবে ২৬ বছর।

যে ৭৫% আগ্নিবীর পূর্ণ সেবা দিতে পারবে না। তাদের জন্য অনেক রাজ্য সরকার ১০০%, কেন্দ্রীয় সরকার অর্ধসৈনিক বলে যোগদানের অগ্রাধিকার দেবেন।

সেনাতে শর্ট সার্ভিস কমিশনে (অফিসার বিভাগে) প্রথমে ৫ বছর মেয়াদ ছিলো। তারপর দরকারে ৫+২ বছর হলো। তারপরে আবার ১০ বছর হলো। এখন বর্তমানে ১০+৪ বছর হয়েছে আর অনেক সুযোগ সুবিধাও দেওয়া শুরু হয়েছে যেগুলো আগে ছিল না। জেসিও জওয়ানেও বর্তমানে ২ বছরের ঐচ্ছিক এক্সটেনশনের ব্যবস্থা আছে যেটা আগে ছিল না।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *