দুই বছর গৃহবন্দি থাকার পর শতবর্ষ প্রাচীন মণি বাঈজীর রথ চলবে পুরুলিয়ার রাস্তায়

সাথী দাস, পুরুলিয়া, ৩০ জুন: দুই বছর গৃহবন্দি থাকার পর শতবর্ষ প্রাচীন মণি বাঈজীর রথ চলবে পুরুলিয়ার রাস্তায়। করোনা আবহে প্রশাসনিক অনুমতি না থাকায় রথ যাত্রা স্থগিত রাখতে হয়েছিল টানা দুই বছর। এবার মহাসমারোহে উৎসবের আমেজে রথের দড়ি টানার সুযোগ পাবেন পুণ্যার্থীরা।

১৯১২ সালে এক বাঈজীর সূচনা করা রথ আজও সমান মর্যাদায় ঐতিহাসিক রথযাত্রা উৎসব হিসেবে পালিত হয় পুরুলিয়ায়। পঞ্চকোট রাজাদের আমলে লক্ষৌ থেকে মুন্নি বাঈ বৈষ্ণব ধর্মে দীক্ষিত হয়ে বৈষ্ণবীর জীবন যাপনে অভ্যস্ত হন। পরে মনমোহিনী বৈষ্ণবী নামে খ্যাত হন তিনি। ১৮৯৮ সালে পুরুলিয়া শহরের প্রাণ কেন্দ্র চকবাজারে একটি মন্দির নির্মাণ করেন তিনি। সেখানে শ্রী শ্রী রাধাগোবিন্দ জিউয়ের বিগ্রহ অধিষ্ঠিত করিয়ে রথ যাত্রার সূচনা করেন। নানান দেব দেবীর মূর্তি ও কারু-কার্যে ভরা পিতলের রথটি এক দারুন শিল্প শৈলীর নিদর্শন হয়ে দেখা দেয়। নির্মাণকালে রথটি দৈর্ঘ্যে ও প্রস্থে ১২ ফুট এবং উচ্চত প্রায় ২২ ফুট ছিল। কিন্তু, পরে রথ যাত্রার নির্দিষ্ট (পোষ্ট অফিস মোড় থেকে রথ তলা পর্যন্ত প্রায় দুই কিলোমিটার) পথের দু’পাশে দোকান ও পাকা ঘর নির্মাণের ফলে, রাস্তা সঙ্কীর্ণ হয়ে যায়। সেই কারণে রথটির দৈর্ঘ্য, প্রস্থ এবং উচ্চতার সংস্কার করা হয়। চার দিকে দু’ফুট করে কমানো হয়। দশ চাকার পরিবর্তে আট চাকা লাগানো হয়।

রাধা গোবিন্দ জিউয়ের দৈনন্দিন সেবা পূজা ও রথযাত্রা উৎসব সুষ্ঠভাবে পরিচালনার জন্য মণি বাঈজী পুরুলিয়া শহরের তৎকালীন কিছু বিশিষ্ট ব্যক্তিকে নিয়ে একটি ট্রাস্টি বোর্ড গঠন করেন। সেই বোর্ডের অন্যতম এক্সিকিউটর চকবাজারের বাসিন্দা নন্দলাল দত্ত কয়ালের পরিবার বংশানুক্রমে ১৯২২ সাল থেকে সেই দায়িত্ব পালন করে আসছেন। সেই বংশেরই বর্তমান পরিচালক বর্ষীয়ান শচী দুলাল দত্ত বললেন, সূচনাকালে রথ যাত্রা উৎসব হরি নাম সংকীর্তন এবং নানাবিধ বাদ্যযন্ত্র সহযোগে কুড়ি জন কুলির টানে সূর্যাস্তের আগেই শেষ হয়ে যেত। ১৯৬৩ সাল থেকে গ্যাস বাতির আলোকমালায় সু-সজ্জিত রথটি সন্ধের পর যাত্রা শুরু করা হয়। ঠিক তার আট বছর পর আধুনিকতার ছোঁয়া লাগে। বৈদ্যুতিক আলোয় সাজানো হয় রথটিকে। রথের দিন নানা দুর্ঘটনা এড়াতে ২০০০ সালে রথটির নক্সা পরিবর্তন করা হয়। রথ টানার জন্য কুলিদের সঙ্গে সঙ্গে ট্রাক্টরের সাহায্যে রথ চালিত করা হচ্ছে। অন্যতম বৈশিষ্ট্য হল কৃষ্ণ-বলরাম-সুভদ্রা নন, এই রথে রাধা-গোবিন্দই অন্যতম দেবতা – যাঁরা রথে থাকেন। প্রশাসনের সহযোগিতায় সুশৃঙ্খলভাবে রথের দিনে ধর্মপ্রাণ ও উৎসব প্রিয় মানুষ জাতি-বর্ণ নির্বিশেষে মিলে মিশে একাকার হয়ে যান। কালের গতিতে সংস্কৃতির পরিবর্তন হলেও ট্রাক্টর চালিত বাঈজীর প্রতিষ্ঠিত রথেই মেতে উঠেন পুরুলিয়াবাসী।

অছি পরিষদের পরিচালক বর্ষীয়ান শচী দুলাল দত্ত জানান, ‘ মুন্নি বাঈ এক সময় উপেক্ষিত থাকলেও বৈষ্ণব ধর্মে দীক্ষিত হয়ে বৈষ্ণবীর জীবন যাপনে অভ্যস্ত হন এবং তাঁর সন্মান পান। তাঁর তৈরি রথ গৌরব বাড়িয়েছে জেলার।”

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *